১০০ বিলিয়ন ডলার হারানোর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবেন গৌতম আদানি?
আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যে ধস নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ট সেলার ও বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা- হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের পক্ষ থেকে কারসাজির অভিযোগের পর। এই বাস্তবতায়, শিল্পগোষ্ঠীটির উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা কি রক্ষা পাবে? নাকি আরো দূরবস্থা অপেক্ষা করছে তাদের সামনে? বিবিসি অবলম্বনে
বাজারমূল্য পতনের শুরুটা যেভাবে?
বন্দর থেকে বিদ্যুৎ – বহুমুখী খাতে রয়েছে আদানি গ্রুপের ব্যবসা। দুই সপ্তাহ আগেও তাদের বাজার নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর সামষ্টিক মূল্যায়ন ছিল ২২০ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু, গত ২৪ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি এবং হিসাবরক্ষণে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনে। তখন থেকে আদানি কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য অর্ধেক পড়ে গেছে।
গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানির সম্পদমূল্য কমেছে শেয়ারে ধস নামায়। ফলে তৃতীয় সেরা ধনী থেকে বর্তমানে তিনি বিশ্বের সেরা ২০ ধনীর মধ্যেও নেই।
হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে আনীত সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে আদানি গ্রুপ। তারা এসব অভিযোগকে 'ক্ষতিকর' ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করে। একইসঙ্গে, জানায় এতে তাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা বদলায়নি। কিন্তু, তাতে বিনিয়োগকারীদের সংশয় দূর হয়নি।
গতকাল সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এক বিবৃতিতে আদানি গ্রুপ জানায়, আগামী বছর মেয়াদ পূর্ণ হবে ১১০ কোটি ডলারের এমন একটি ঋণ তারা অগ্রীম পরিশোধ করবে। 'বাজারে চলমান অস্থিতিশীলতা'র মধ্যে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতেই এ উদ্যোগ বলে জানায় তারা।
গেল সপ্তাহে বাজার থেকে নিজেদের সেকেন্ডারি শেয়ার প্রত্যাহার করে আদানি গ্রুপ। এই শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া ২৫০ কোটি ডলার দিয়ে দেনা পরিশোধ এবং নতুন প্রকল্প অর্থায়নের লক্ষ্য ছিল। যেসকল প্রকল্পে অর্থায়ন করা হতো তারমধ্যে ছিল- বিমানবন্দর সংস্কার, উড়ালসড়ক নির্মাণ এবং গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প।
শেয়ারমূল্যে পতন বড় সমস্যা কেন?
কোনো কোম্পানির শেয়ারমূল্যে বড় ধরনের দরপতনে বোঝা যায়, তাদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
এই মূল্য পতনে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর পরিচালন, অর্থ প্রবাহ ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় কেমন প্রভাব পড়বে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন বিশ্লেষকরা।
ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্স- জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূষণমুক্ত জ্বালানিতে ব্যবসা রুপান্তরের সাথে সম্পর্কিত আর্থিক বিষয়ের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। সংস্থাটির একজন পরিচালক টিম বাকলি বলেন, 'তাদের অধিকাংশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার পরিধি কাটছাঁট করতে হবে, যে সময়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল- তাও পেছাতে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে (বড়) তহবিল সংগ্রহের সক্ষমতা নেই আদানি গ্রুপের'।
পুঁজিবাজার থেকে অর্থ ধার করতে পারলে, তা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু এবং দরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারতো আদানি গ্রুপ। এর আগে এটাই ছিল আদানি গ্রুপের অবকাঠামো কোম্পানিগুলোর প্রচলিত কৌশল, যা শিল্পগোষ্ঠীটির ব্যাপক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু, এভাবে তাদের দেনার পরিমাণ রাজস্ব ও মুনাফার চেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনেও একথা বলা হয়েছে। বলেছেন, অন্য কয়েকজন বিশ্লেষকও।
আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো কী আরো অর্থ ধার করতে পারবে?
ইতোমধ্যেই আদানি গ্রুপের মোট ঋণ প্রায় দুই লাখ কোটি রুপি বা ২৪ বিলিয়ন ডলার। গত তিন বছরে যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, এই সময়ে ফাইভজি নেটওয়ার্কসহ গ্রিন হাইড্রোজেন খাতেও ব্যবসার বিস্তার ঘটান গৌতম আদানি।
আদানি গ্রুপের দুই-তৃতীয়াংশ ঋণ নেওয়া হয়েছে বন্ড বিক্রি বা বিদেশি ব্যাংকের মতো বাহ্যিক উৎসগুলো থেকে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বৈশ্বিক ব্রোকারেজ সংস্থা- জেফ্রিস।
এখন পর্যন্ত অবকাঠামো সম্পদ বা শেয়ারকে জামানত হিসেবে রেখেই অধিকাংশ তহবিল সংগ্রহ করেছে শিল্পগোষ্ঠীটি। কিন্তু, শেয়ারমূল্যে পতন হতে থাকায়, এসব জামানতের মূল্যও কমে গেছে। এই বাস্তবতায়, দুটি বৃহৎ ব্যাংক- ক্রেডিট সুইস এবং সিটিগ্রুপের বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপক ইউনিট আদানি গ্রুপের বন্ড জামানত হিসেবে গ্রহণ বন্ধ করেছে বলে জানা যায় ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন সূত্রে।
আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোকে শত শত কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে ভারতের অনেক ব্যাংকও। এতে বিনিয়োগ রয়েছে, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা কোম্পানি– লাইফ ইন্সুরেন্স অব ইন্ডিয়া (এলআইসি)'র।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন এবং তার প্রতি বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া ঋণদাতাদের আরো সতর্ক করবে– এতে করে আদানি গ্রুপের ঋণ গ্রহণের ব্যয় (সুদহার) বেড়ে যেতে পারে।
ভারতীয় একজন কর্পোরেট ব্যাংকার নাম না প্রকাশের শর্তে বিবিসিকে বলেন, 'আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে তাদের পক্ষে নতুন ঋণ নেওয়া খুবই কঠিন হবে, বিশেষ করে বিদেশের বাজার থেকে'।
আরেকজন পর্যবেক্ষক এবং সাবেক ব্যাংকার যিনি একটি আন্তর্জাতিক সম্পদ তহবিলের সাথে যুক্ত, নাম না প্রকাশের শর্তে বিবিসিকে বলেন, বর্তমান সমস্যাগুলো থিতু হওয়ার আগপর্যন্ত আদানি গ্রুপ কিছু প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে দিতে বাধ্য হবে।
এসব বিষয়ে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা রেখে, আদানি গ্রুপকে একটি প্রশ্নতালিকা পাঠায় বিবিসি। তার জবাবে গ্রুপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, 'পরিকল্পনা-মাফিক আমাদের বর্তমান সকল প্রকল্প অব্যাহত থাকবে। আদানি গ্রুপের মৌলিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়নি'।
আদানি গ্রুপের কোন প্রকল্পগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে?
আদানি গ্রুপের ওপর নিরীক্ষণও বেড়েছে। তাদের তহবিল সংগ্রহ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নতুন আলোকে যাচাই করছে বিনিয়োগকারী ও ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) সংস্থাগুলো।
এরমধ্যে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস আদানি গ্রুপের দুটি কোম্পানির জন্য তাদের প্রদত্ত প্রবৃদ্ধির আভাসকে ঋণাত্মকে নামিয়ে এনেছে।
সংস্থাটি জানায়, 'নতুন তদন্তগুলো এবং বাজারে নেতিবাচক মনোভাব তাদের পুঁজি সংগ্রহের খরচ বাড়িয়েছে, ফলে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল উৎস সংকুচিত হয়েছে'।
এদিকে সেকেন্ডারি শেয়ার বিক্রি শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহারের পর দেওয়া এক ভিডিও বিবৃতিতে গৌতম আদানি বলেছেন, তার গ্রুপের ব্যালান্স শিট 'সবল এবং সম্পদগুলোয় তেজিভাব বজায় রয়েছে'। তিনি আরো জানান যে, দেনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পূরণে 'অনবদ্য এক ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে' তার গ্রুপের।
কিন্তু, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আইসিআরএ গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেছে, বিশাল অঙ্কের ঋণের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করে সেখান থেকে ব্যয় করা এখন আদানি গ্রুপের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
অথচ ঋণের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে আদানি গ্রুপের মূল প্রতিষ্ঠান– আদানি এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড (এইএল)। এই কোম্পানির অধীনেই বন্দর ব্যবস্থাপনা, সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্প চালিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে বিপুল পুঁজি লগ্নী করার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে এইএল এর হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ আছে, কিন্তু নিজেদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গেলেই অর্থের যোগান নিয়ে সমস্যায় পড়বে তারা।
তবে আদানি গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠানের সমুদ্র বন্দর, এয়ারপোর্ট ও কারখানার মতো স্থাবর সম্পদের মালিকানা ও পরিচালনা স্বত্ব থাকায় তারা পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে আগের ওই কর্পোরেট ব্যাংকার বলেন, 'আদানি পোর্টস এবং আদানি পাওয়ার হলো গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে পুঁজি-সমর্থিত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তাদের অনেক সম্পদই সরকারের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত। এই কোম্পানিগুলো অধিকাংশ ঋণই নিয়েছে তাদের রাজস্ব এবং মুনাফা অর্জনকারী সম্পদের বিপরীতে'।
তবে এতটা সুহাল নেই আদানি গ্রুপের নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয়।
এর মধ্যেই হিসেবের খাতায় বিপুল দেনার অংক রয়েছে আদানি গ্যাস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানি আদানি গ্রিনের। নগদ অর্থের মজুতও তারা কেবলমাত্র তৈরি করছে। ফলে পুঁজিবাজারের ধাক্কায় তাদের বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, এতে তাদের ঋণগ্রহণের সক্ষমতাও হ্রাস পাবে।
ওই ব্যাংকার উল্লেখ করেন, আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেডের বন্ডের দাম সামান্য কমলেও –- সে তুলনায় আদানি গ্রিনের বন্ডের মূল্য মাত্র তিনদিনে ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে।
গৌতম আদানির সামনে উপায়গুলো কী?
কিছু প্রকল্প স্থগিত রাখা এবং সম্পদ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা একটা উপায় হতে পারে। আইসিআরএ বলেছে, তাদের পুঁজি ব্যয়ের কিছু পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক নয়, এবং এগুলো চাইলে পরে করা যাবে। হাতে থাকা তারল্যের ওপর ভিত্তি করে তারা এসব বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন কর্পোরেট পরামর্শক বিবিসিকে বলেন, 'এই শিল্পগোষ্ঠী এমন কিছু সম্পদ তৈরি করেছে, যা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মুল্যবান সম্পদ। এজন্য অনেক কৌশলগত বিনিয়োগকারী তাদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন'।
আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তাদের মধ্যে রয়েছেন, অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ এবং ইনফ্রাভিশন ফাউন্ডেশনের স্ট্রাস্টি বিনায়ক চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, 'বন্দর, এয়ারপোর্ট, সিমেন্ট থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অনেক খাতে আদানি প্রকল্পগুলোকে আমি সবল, স্থিতিশীল বলে দেখতে পাচ্ছি, এগুলো যথেষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থও আয় করছে। ফলে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনের এই পালা থেকে তারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে'।
তবে শেয়ারমূল্যে কারসাজির অভিযোগের পর, গ্রুপটির বিরুদ্ধে দেশটির পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় কিনা– সেদিকেও নজর রাখছেন অনেক পর্যবেক্ষক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণেই তার গ্রুপের ওপর বাজার নিয়ন্ত্রকদের শিথিল নজরদারি ছিল- এমন অভিযোগে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনও। যদিও এ অভিযোগ মোদি ও আদানি উভয়েই অস্বীকার করেছেন। কিন্তু, এবিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়ে সোমবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
টিম বাকলি বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের চাপ বাড়লে, আদানি গ্রুপের পক্ষে সহজে সরকারি চুক্তিগুলো পাওয়া কঠিন হবে। এতে তাদের রাজস্ব বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও ব্যাহত হবে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকে শক্তিশালী অবস্থায় নিতে কষ্ট হবে তাদের। তখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেনা পরিশোধে তাদের কৌশলগত কিছু সম্পদ বিক্রি করতে হবে।