রকেট থেকে বল বিয়ারিং, যুদ্ধ সরঞ্জামের চাহিদা মোকাবিলায় তাল হারাচ্ছে পেন্টাগন
পেন্টাগন যখন ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, একইসঙ্গে এটি নজর রাখছে চীনের ওপরও। ওয়াশিংটনের আশঙ্কা তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়ে নতুন করে বৈশ্বিক সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে চীন। আর এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নতুন সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর।
এ সমস্যা সমাধানে পেন্টাগন, হোয়াইট হাউস, কংগ্রেস ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঠিকাদার; সব পক্ষই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে। পেন্টাগনের বাজেট ক্রমশ বাড়ছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী বর্তমানে অস্ত্র সরবরাহকারীদেরকে একাধিক বছরের চুক্তির প্রস্তাব দিচ্ছে যাতে এসব সরবরাহকারী নিজেদের অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়।
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর গত ১০ মাসে ইউক্রেনকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের মতো সামরিক সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ভান্ডার থেকে ইউক্রেনেকে এত পরিমাণ স্টিংগার মিসাইল দিয়েছে যে, বর্তমান সক্ষমতায় এ ভান্ডার পূরণ করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ বছর লাগবে। আর জ্যাভেলিন মিসাইলের ক্ষেত্রে এ সময় ধরা হয়েছে পাঁচ বছর।
যদি চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো যুদ্ধ বেঁধে যায়, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত দীর্ঘপাল্লার জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল শেষ হয়ে যাবে। আর চীনের সঙ্গে যেকোনো যুদ্ধে এ অস্ত্রটি আমেরিকার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রিসিশন মিসাইল ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সলিড রকেট মোটরের ঘাটতিতেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৫ সালে ছয়টি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, ও মেরিনের জন্য বড় সংখ্যায় রকেট মোটর তৈরি করত। বর্তমানে এ ধরনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কেবল দুইটি।
সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের গতি হ্রাস করে দেওয়ার পেছনে সাধারণ সরঞ্জামের ঘাটতি একটি বড় প্রভাবক। যেমন বল বিয়ারিংয়ের মতো সাধারণ এ যন্ত্রাংশটি অনেক মিসাইলের গাইডেন্স ব্যবস্থার একটি মৌলিক উপাদান। এছাড়া বিভিন্ন ইঞ্জিন তৈরিতে প্রয়োজনীয় স্টিল কাস্টিংয়ের ঘাটতিতেও ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র।
স্নায়ুযুদ্ধের পরে করা 'পিস ডিভিডেন্ড' বর্তমান এ সরঞ্জাম সংকটের অন্যতম মৌলিক কারণ। ওই সময় অস্ত্র সংগ্রহ কমিয়ে আনার পাশাপাশি ও বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৯৩ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ওই বছর মার্কিন প্রশাসন সামরিক বাজেট কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব লেস অ্যাসপিন এক ভোজের আয়োজন করেন সব সামরিক ঠিকাদারদের নিয়ে। 'দ্য লাস্ট সাপার' নামে খ্যাত ওই ভোজসভায় ঠিকাদারদের বার্তা দেওয়া হয়, তাদের অনেককে একীভূত হতে হবে অথবা ব্যাবসা ছেড়ে দিতে হবে।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধের মতো বেশি তীব্রতাসম্পন্ন স্বল্পকালীন যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। আবার একইসঙ্গে আফগানিস্তানে দীর্ঘকালীন ও স্বল্প তীব্রতার যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে।
এসব যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়নি। তারপরও এ যুদ্ধগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অস্ত্র সংকটের আভাস ফুটে উঠেছিল। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুদ্ধের পর ২০১৬ সালের মধ্যেই প্রিসিশন মিসাইলের ঘাটতিতে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।
পেন্টাগন তখন অল্প সময়ের জন্য উৎপাদন বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু তা ছিল সাময়িক একটি পদক্ষেপ। এছাড়া সামরিক শিল্পগুলোর নিয়োগ করা লবিয়িস্টরাও ওয়াশিংটনকে এমন সব সামরিক প্রজেক্টে অর্থ ঢালতে রাজি করাতেন, যেগুলো থেকে ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো।
লবিয়িস্টদের কারণে মার্কিন সরকার এক সময় নতুন জাহাজ, বিমান ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের সামরিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে শুরু করে। একইসঙ্গে এ লবিয়িস্টরা কংগ্রেসের ওপর চাপ দিতে থাকে পুরোনো সংস্করণের জাহাজ ও বিমানগুলো সার্ভিসে সক্রিয় রাখতে। এসব যুদ্ধযানের যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা না থাকলেও এগুলোকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সাজাতে ও জনবল নিয়োগ করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় মার্কিন সরকারকে।
এর ফলে মিসাইল ও গোলাবারুদের মতো অন্যান্য কম মূল্যের সামরিক সরঞ্জামগুলোর ওপর খরচ কমিয়ে সার্বিকভাবে সামরিক বাজেট সংরক্ষণের চর্চা শুরু হয় দেশটিতে।
তবে এ অভ্যাস শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, এর ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যেও দেখা গেছে। পোল্যান্ড এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অত্যাধুনিক এ যুদ্ধবিমানের প্রতিটির দাম প্রায় ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ডের কাছে এ বিমানে দুই সপ্তাহের বেশি ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত মিসাইল নেই।
ঘাটতি থেকে রেহাইয়ে পেন্টাগন এখন নতুন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে গোলাবারুদের সংগ্রহশালার পরিমাণ কম থাকবে, কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতার ওপর বেশি নজর দেওয়া হবে।
বাইডেন প্রশাসন এ সপ্তাহে মিসাইল ও গোলাবারুদ কেনার জন্য গত বছরের তুলনায় সামরিক বাজেট ৫১ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এ জন্য সব মিলিয়ে ৩০.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবনা জানিয়েছে তারা।
লকহিড মার্টিন-এর মতো বড় বড় সামরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মিসাইল প্রোগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নজর দিচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন মিত্রদেশের কাছে কাছে ঘাটতিতে থাকা যন্ত্রাংশের সন্ধান করছে দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ।
গত বছর ৭,৫০০ আর্টিলারি রকেট তৈরির সক্ষমতা ছিল লকহিডের। এসবের অধিকাংশ খরচ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে, হিমার্স লঞ্চারের পেছনে। এ বছর এ উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ১০,০০০-এ। তারপরও এ সংখ্যা পেন্টাগনের চাহিদার চেয়ে অনেক কম। এমনকি কেবল ইউক্রেনে সরবরাহ করার জন্যও এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। আর আর্টিলারি রকেটের মতো আরও এক ডজেনের বেশি রকেট ও মিসাইল ব্যবস্থার উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে বর্তমানে কাজ করছে মার্কিন সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো।
গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন কংগ্রেস পেন্টাগনকে সামরিক ঠিকাদারদের সঙ্গে কয়েক বছর ব্যাপী চুক্তি করার ক্ষমতা দিয়েছে। এর ফলে অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক নিশ্চয়তা পাবে যার মাধ্যমে তারা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অন্য ছোট প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করতে পারবে।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী নীতিকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টাও করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ মুহূর্তে দেশটি আর নতুন করে সামরিক শিল্পগুলোকে একীভুত করতে চায় না। গত বছর লকহিড মার্টিনের ৪.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অ্যারোজেট রকেটডাইনকে কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত করে দিয়েছে ফেডারেল ট্রেড কমিশন।
অ্যারোজেট সম্প্রতি নিজস্ব রকেট ইঞ্জিন প্ল্যান্টকে আরও বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করেছে। আরকানসাস ও আলাবামার প্ল্যান্টে কোম্পানিটি মার্কিন নৌবাহিনীর প্রত্যাশিত এসএম-৬ মিসাইলের রকেট মোটর তৈরি করে। এছাড়া প্যাক-৩ মিসাইল ব্যবস্থাও অ্যারোজেট তৈরি করে। যেকোনো মিসাইল হুমকি মোকাবিলায় প্যাক-৩ মিসাইল ব্যবস্থা হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে তাইওয়ান।
বর্তমান সময়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম কোনো একক সরবরাহকারীর পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঘাটতি সংকট মোকাবিলায় বর্তমানে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়ে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা এটাও স্বীকার করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মুখোমুখি হওয়া হুমকিকে অতীতে অবমূল্যায়ন করেছিল।