সৌদি-ইরান চুক্তিতে বাণিজ্য, জ্বালানি, আর্থিক ও নৌ-শক্তিতে লাভবান হবে মধ্যস্থতাকারী চীন
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বহু দেশে ও নিজস্ব অবকাঠামোতে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে দেশটির বিনিয়োগের এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সমসাময়িক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে লাভজনক বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। খবর দ্য কনভারসেশনের।
সম্প্রতি চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদারে তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে হন্ডুরাস। বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের একটি হিসেবে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল হন্ডুরাস।
হন্ডুরাসের কূটনৈতিক নীতির বিরাট এ পরিবর্তন অবশ্য চীনের জন্য ইতিবাচক। কেননা চীন তাইওয়ানকে নিজেদের অঞ্চল বলেই দাবি করে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে চীনের এ দাবির বিরোধিতা করে তাইওয়ানকে সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে হন্ডুরাসের কূটনৈতিক নীতির এ পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তির একটি কারণ হতে পারে। একইসাথে ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র যে ক্রমশ প্রভাব হারাচ্ছে, ঘটনাটি তারই বার্তা বহন করে।
তবে শুধু ল্যাটিন আমেরিকায় নয়, বর্তমানে চীনের প্রভাব বিশ্বের প্রায় সব অংশেই দৃশ্যমান। সম্প্রতি চলমান যুদ্ধের মাঝেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতাকে পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া সফর করেছেন। এ সফরের আগে আবার চীন মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরাশক্তি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পাদিত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছে।
বর্তমানের খুবই আলোচিত এ চুক্তিতে মূলত ইরান ও সৌদির মধ্যকার বাণিজ্য ও পারস্পরিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একইসাথে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা অর্জনের বিষয়টিও উঠে এসেছে।
দুই দেশের চুক্তিটিতে মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে চীন এবার শুধু নিজেদের বাণিজ্যিক দিকেই নজর দেয়নি। বরং বাণিজ্যের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ও প্রবাসীদের নিরাপত্তাজনিত বিষয়টিকেও আমলে নিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জন্য চুক্তিটিকে বেশ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কেননা দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি-ইরান পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িত। একইসাথে সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে তারা পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
এক্ষেত্রে সৌদি-ইরান চুক্তি উক্ত অঞ্চলের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে অঞ্চলটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য হ্রাসের সম্ভবনা বৃদ্ধি পাওয়ায় চুক্তিটি সবচেয়ে নজর কেড়েছে।
তবে চীনের এ পরিকল্পনা নতুন নয়। ১৯৯০ এর দশক থেকেই চীন ধীরে ধীরে আরব অঞ্চলে নিজেদের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে। বিশেষ করে অঞ্চলটির অন্যতম পরাশক্তি সৌদি আরবের সাথে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে।
চীন প্রতি বছর গড়ে ১৫.৩ শতাংশ হারে সৌদি আরবে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। ১৯৯৫ সালে দেশটিতে চীনের রপ্তানি ছিল মাত্র ৯০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে সৌদিতে চীনের এ রপ্তানি ৩১.৮ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে।
অন্যদিকে সৌদি আরব থেকে চীনের আমদানির পরিমাণও গড়ে প্রতি বছর ১৯.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে দেশটি থেকে চীনের আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে সেটি এসে পৌঁছেছে ৩৩.৪ বিলিয়ন ডলারে। এছাড়াও ২০১৯ সালে দেশ দুটি মোট ৩৫ টি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি করেছে।
একইসাথে চীন-ইরানের বাণিজ্যিক সম্পর্কও সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে ইরানে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে গড়ে ১৪.৭ শতাংশ হারে বেড়ে তা পৌঁছেছে ৮.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
ইরান থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়। ১৯৯৫ সালে ইরান থেকে চীনের পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে ১৪.৫ শতাংশ হারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৮৫ বিলিয়ন ডলারে।
২০২১ সাথে ইরানে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ৯.৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে এবং ২০২৩ সালে তা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও সম্প্রতি চীনকে টপকিয়ে ইরানের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে রাশিয়া। তবে এখনো ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন।
চীন মূলত সৌদিতে মোটর গাড়ি, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি ও এয়ার পাম্প ইত্যাদি রপ্তানি করে থাকে। আর সৌদি থেকে দেশটি আমদানি করে পেট্রোলিয়াম, ইথিলিন পলিমার, এক্রিলিক এলকোহল ইত্যাদি।
সৌদি-ইরাকের চুক্তির কারণে দেশ দুটিতে চীনের বাণিজ্যের সুযোগ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। একইসাথে এ চুক্তির কারণে অঞ্চলটিতে স্থিতিশীলতা বাড়লে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও চীন নিজেদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারবে।
সৌদির সাথে চুক্তিটির পর ইতোমধ্যেই ইরানের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। দেশটি বাহরাইন, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্ক জোরদারের ইঙ্গিত দিয়েছে।
তবে ইরান ও সৌদির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে এর আগেও বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ পরবর্তীতে আর আলোর মুখ দেখেনি। একইসাথে দেশ দুটি বর্তমান চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলবে কি-না সেটি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
অন্যদিকে নিজেদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে চীন বহু আগেই 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' গ্রহণ করেছে। একইসাথে এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও বিনিয়োগকৃত দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়েছে চীন।
আর ইরান-সৌদির এই চুক্তিটি চীনের 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' এর লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক হবে। কেননা ভৌগলিকভাবে সৌদির সাথে মোট আটটি দেশের সীমান্ত রয়েছে। এই দেশগুলোর মাধ্যমে সৌদি থেকে চীনে জ্বালানি পাঠানো সহজতর হবে। একইসাথে সৌদির প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে চীন নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে।
অন্যদিকে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে চীন ইরান থেকে সমুদ্রবন্দরের সুবিধা পেতে পারে। একইসাথে আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে হাব হিসেবে ইরানের বিমানবন্দর ব্যবহার করার সম্ভবনা রয়েছে চীনের। আবার স্থলভাগে ইতোমধ্যেই চীন জিনজিয়াং থেকে তেহরান পর্যন্ত ২ হাজার মাইল দীর্ঘ রেলপথ তৈরির উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে।
গত বছর থেকেই ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অস্থির জ্বালানির বৈশ্বিক বাজার। এ অবস্থায় চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য দরকার জ্বালানির নির্ভরযোগ্য উৎস। সেক্ষেত্রে খুবই ভালো সমাধান হতে পারে সৌদি ও ইরানের জ্বালানি।
কেননা ইরানের রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ তেল ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্যাসের মজুদ। অপরদিকে সৌদির রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তেলের মজুদ যা বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ১৬.২ ভাগ।
তাই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে চীন দেশ দুটি থেকে জ্বালানি আমদানি করে লাভবান হতে পারবে। একইসাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রখে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারবে তারা।