দেশ ছাড়ছে শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্তরা
শ্রীলঙ্কায় অভিবাসী এবং প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের বাইরে দেশটির নাগরিকদের যে দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে তার সাথে কেবল গত বছরে সংকটকালীন চরম মুহূর্তে জ্বালানি এবং ভোজ্য তেল সংগ্রহের লাইনকেই তুলনা করা যায়। ২০২২ সালে ৮ লাখ ৭৫ হাজার পাসপোর্ট ইস্যু করেছে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ, যেটি তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এই শ্রীলঙ্কানরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট এবং অনিশ্চয়তার কারণে।
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লক্ষে জনগণের মধ্যে ২০২২ সালেই ৩ লক্ষ মানুষ বাইরের দেশে কাজ খুঁজতে গিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কম বা মধ্যম দক্ষ শ্রমিক। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসেই দেশ ছেড়েছে আরও ৭৩,০০০ শ্রীলঙ্কান। প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে মধ্যবিত্ত পেশাজীবিরাও এই দেশত্যাগী জনস্রোতে শামিল হয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা কর্মী সংকটে ভুগছেন, যাদের মধ্যে ম্যানেজার পদও রয়েছে। খালি থাকা ম্যানেজার পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাদেরকে আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সাধারণত ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদেরই নিয়োগ দিতো এবং এ বয়সের তরুণেরাই চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরিতে যোগ দিতেন। তবে এখন চল্লিশ এবং পঞ্চাশ বছর বয়সীরাও চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার দীর্ঘমেয়াদী সংকটের কারণেই তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫০.৬%। এদিকে করের হার বাড়ানো সত্ত্বেও এর তুলনায় কর্মীদের বেতন তেমন বাড়ছে না। জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট রনীল বিক্রেমেসিংহে আইএমএফ-এর ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে বেশ কয়েক দফা কর বাড়িয়েছেন, যারা দেশটিকে 'পৃথিবীর অন্যতম কম লাভজনক ব্যবস্থা' হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে আয়করের হার ৩৬%। এদিকে এই করের পরিমাণ বাড়ার ফলে দেশ ছেড়ে দলে দলে আরও শ্রীলঙ্কান বলে আশঙ্কা করছে বিরোধী দল 'ন্যাশনাল পিপল'স পাওয়ার পার্টি'।
সামাজিক মাধ্যমের সহায়তায় দেশের ভেতরে কাজ করার জন্য তরুণদেরকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজিথা সেনেভিরত্নে নামক এক ৩৭ বছর বয়সী এয়ার-ট্রাফিক কন্ট্রোলার। তিনি জানান, তার ইউনিয়ন জানিয়েছে, যদি আর 'চার থেকে পাঁচজন সদস্য' চাকরি ছেড়ে চলে যান, তাহলে পুরো এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
শত শত ডাক্তার ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, যার মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসেই গিয়েছেন ৪৭৭ জন। এভাবে এগোতে থাকলে গ্রামীন অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার সংকট দেখা যাবে। অনেকের মতে বিক্রেমেসিংহে বলেছেন যে, "শীঘ্রই হোটেলগুলোতে ওয়াইন পরিবেশন করার মতো লোকও থাকবে না।"
এদিকে শ্রীলঙ্কান সরকারও এই দেশ ছেড়ে পালানোকে উৎসাহিত করছেন। প্রথমত, সরকারি খাতে বেতনের বোঝা কমানোর জন্য এবং দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের আশায়। এদিকে ডাক্তারদের জন্য গত জুন মাসে সুবিধা ঘোষণা করেছিল শ্রীলঙ্কান সরকার: তাদেরকে পাঁচ বছরের জন্য ছুটি দেওয়া হবে, যদি তারা বিদেশে গিয়ে প্রতি মাসে ১০০-৫০০ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে।
এদিকে প্রবাসী নিয়োগ মন্ত্রী মনুশা নানায়াক্কার বিভিন্নভাবে শ্রীলঙ্কান কর্মীদেরকে দেশের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করছেন। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকরির সুযোগের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন তারা। 'রাতা ইয়ামু' বা 'চলো বিদেশে যাই' নামের এক ইউটিউব চ্যানেল থেকে জনগণের কাছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিদেশে চাকরির সুযোগ প্রচার করছে তারা।
নার্সিং, কেয়ার-গিভিংসহ অন্যান্য সেবামূলক কাজেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে শ্রীলঙ্কান সরকার, যাতে করে কাতার, কুয়েত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে তারা কাজের ব্যবস্থা করতে পারে। গত বছরে বিদেশে পাড়ি জমানো ৪০ শতাংশ শ্রীলঙ্কানই এই তিনটি দেশে গিয়েছে। নতুন নতুন ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনিস্টিউট খোলা হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়, এতে সহায়তা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও।
এই নীতিগুলোর মাধ্যমে আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছে শ্রীলঙ্কান সরকার। গত চার মাসে রেমিট্যান্সের হার বেশ খানিকটা বেড়েছে। তবে এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় মেধারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, যাদেরকে দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন।
নানায়াক্কার জানিয়েছেন সেবা এবং উৎপাদন খাতে ইতিমধ্যেই কর্মী সংকট দেখা গিয়েছে। এটি প্রতিরোধের জন্য কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান 'লয়্যালটি বোনাস' ঘোষণা করেছে, অর্থাৎ চাকরি না ছাড়লে অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হবে। এছাড়াও দিলমাহ সিলন টি নামক এক চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্মীদের অতিরিক্ত করের টাকা পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এরপরেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না প্রতিষ্ঠানটির সিইও দিলহান ফার্নান্দো।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট