আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা রাশিয়া ছাড়ায় ঝুঁকির মুখে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ
রাশিয়া থেকে রপ্তানির জন্য শস্যের চালান কিনবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বৃহৎ দুটি আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী সংস্থা। এতে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের ওপর রুশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়লো। খবর ব্লুমবার্গের
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে রাশিয়ার আধিপত্য স্পষ্ট হতে থাকে। যুদ্ধের কারণে গত বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে, দামও চড়ে। এরমধ্যেই বৈশ্বিক কৃষি ব্যবসার জায়ান্ট কারগিল ইনকর্পোরেশন এবং ভিটেরা রাশিয়ায় তাদের ব্যবসা বন্ধ করে চলে আসার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে খাদ্য চালানের ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় হলো, এবং এই বাণিজ্য থেকে এখন রুশ সরকারের লাভও বাড়বে।
খাদ্য-ব্যবসার আরেকটি বৃহৎ কোম্পানি আর্চার-ড্যানিয়েলস-মিডল্যান্ড কোং-ও রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম বন্ধের উপায় খুঁজছে। কোম্পানিটির সংশ্লিষ্টদের বরাতে এমন কথাই জেনেছে মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ। এ খাতের আরেকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি লুই ড্রেফাস-ও দেশটিতে তাদের কার্যক্রম সীমিত করার কথা ভাবছে বলে রুশ সংবাদপত্র কমেরসান্তের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহৎ আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর প্রস্থানে রাশিয়ার সরকারই লাভবান হবে। খাদ্য-আমদানিকারক দেশগুলোকে মস্কোর মর্জির ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। রাজস্ব আয়ও তাতে বাড়বে।
কৃষ্ণসাগর অঞ্চল-ভিত্তিক কৃষি বাণিজ্য নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সোভইকোন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্দ্রে সিজোভ বলেন, "(রুশ) কর্তৃপক্ষ চাইলে এখন থেকে (খাদ্য) রপ্তানি প্রবাহ আরো সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, কারণ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করাটা তাদের পক্ষে কঠিন হবে না।"
কারগিল ও ভিটেরার মতো কোম্পানিগুলো কেন রাশিয়া ত্যাগ করছে?
কারগিল ও ভিটেরার রাশিয়ায় বিপুল সম্পত্তি রয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকেই এসব সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে তারা প্রচণ্ড চাপের মুখে ছিল। দেশটির শস্য উৎপাদক কয়েকটি অঞ্চলের গভর্নররা রাশিয়ার খাদ্য বাজারের ওপর বিদেশি সংস্থাগুলোর প্রভাব হ্রাস করতে মস্কোর প্রতি আহ্বানও জানান।
এই প্রেক্ষিতে, খাদ্য বাজারের ওপরের দেশীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিকে নীতি-অগ্রাধিকার দিচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সরকারের সমর্থন থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এ খাতের বৃহৎ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। রুশ সরকারের এই উদ্যোগের আরেকটি কারণ ভূরাজনৈতিক। খাদ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ মস্কোর জন্য ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতীকও হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোও কৃষি ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে, কারগিল ও ভিটেরার বাজার অংশীদারত্বের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-ভিটিবি। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নপুষ্ট ইউনাইটেড গ্রেইন কোম্পানি উঠে এসেছে শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারকের সাড়িতে।
এদিকে মে মাস থেকেই গমের নতুন ফলন রপ্তানির শুরু হবে। সিজোভ বলেন, খুব সম্ভবত এই রপ্তানি মৌসুমের আগেই কোনো একটি সিদ্ধান্তে আসতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। একইসঙ্গে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রপ্তানির নথিপত্র তৈরি করার কাজটি জটিল করেছে রাশিয়া, এমনটাই জানান সংশ্লিষ্টরা।
গত দুই-তিন দশকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্য রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে রাশিয়া; এসময়ে যেসব বহুজাতিক কৃষিপণ্য সংস্থা রাশিয়ায় ব্যবসা করেছে, তারা বিপুল লাভ করে। তাদের সম্পৃক্ততায় এসময় রাশিয়ার গম রপ্তানি পাঁচগুণ বেড়ে যায়, ফলে রাশিয়ার গম সরবরাহ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক গম বাণিজ্যের অন্যতম মূল্য নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।
বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রস্থান বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কারগিল ও ভিটেরার প্রস্থানে রাশিয়ার শস্য সরবরাহের ওপর স্থানীয় ও সরকারি-অর্থায়নপুষ্ট কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণে বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে আরো রাজস্ব আয় করতে পারবে মস্কো।
এভাবে, খাদ্য রপ্তানি ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করবে রাশিয়া। এরমধ্যেই সে প্রভাব স্পষ্ট। যেমন রাশিয়ার শস্য চালানের প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার। এসব দেশের সরকার ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কড়া সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে।
স্টোনএক্স সংস্থার পণ্যবাজার বিষয়ক ঝুঁকি ব্যবস্থাপক ম্যাট অ্যামেরম্যান বলেন, 'রাশিয়ার সরকার আরো বেশি সম্পৃক্ত হলে সেটা বাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকিকেই বাড়িয়ে তুলবে। যদি সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হতে থাকে, তারপরও রাশিয়া যতক্ষণ (নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের উৎস হিসেবে) নিজেকে প্রমাণ না করে, ততক্ষণ সে একটি প্রশ্নবিদ্ধ সরবরাহকারী।"
শস্যের দাম ও বাণিজ্য প্রবাহে যে প্রভাব পড়বে
রাশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় আশ্বস্ত করে বলেছে, এসব পরিবর্তনের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না দেশটির রপ্তানির পরিমাণে। তবে রাশিয়া কীভাবে রপ্তানি চালানের দাম নির্ধারণ করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা। তাদের ধারণা, সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) চুক্তির পরিমাণ বাড়তেই দেখা যাবে।
রাষ্ট্র-সমর্থিত ইউনাইটেড গ্রেইন কোম্পানি এরমধ্যেই তাদের তুরস্ক-ভিত্তিক অংশীদার সংস্থার সাথে বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছে। গত বছর তারা এক বিবৃতিতেও বলেছিল, "আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে আমরা সরাসরি আমদানিকারক দেশগুলোর সাথে ব্যবসা করতে চাই।"
রাশিয়ার শস্য বাজার পুনর্গঠনের এই প্রচেষ্টার ফলে ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চলের শস্যের সাথে রাশিয়ার শস্য মিশিয়ে চালান পাঠানোও সহজ হবে মস্কোর জন্য। এই ধরনের চালান শনাক্ত করাও দুরূহ হয়ে পড়বে।
রাশিয়ার শস্য রপ্তানি যেভাবে হবে
কারগিল ও ভিটেরা মিলে গত মৌসুমে রাশিয়ার মোট উৎপাদিত শস্যের ১৪ শতাংশ চালান দেশটির বাইরে নিয়ে গেছে। ফলে সিংহভাগ বাণিজ্য আগেরমতোই অপরিবর্তিত থাকবে। রাশিয়ার গ্রেইন ইউনিয়ন জানিয়েছে, ভিটেরা স্থানীয়ভাবে নতুন একটি কোম্পানি চালু করেছে এবং তারা এই কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা সচল রাখবে। অন্যদিকে, কারগিল জানিয়েছে, আগামী জুলাই থেকে তারা রাশিয়ান শস্য রপ্তানি বন্ধ করলেও, অন্যান্য কোম্পানির কাছ থেকে রাশিয়ান চালান কেনা অব্যাহত রাখবে।
বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাশিয়ার খাদ্য ও সারের মতো নিত্যপণ্য রপ্তানির ওপর কোনো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তারপরও অনেক শিপিং ও বিমা কোম্পানি নিষেধাজ্ঞা-জনিত ঝুঁকির কারণে দেশটির সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রক্ষা নিয়ে উদ্বেগে আছে। তাদের ঘাটতি পূরণে মস্কো নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির ওপর জোর দিচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোসাগ্রোলিজিং ৬০টি শস্যবাহী জাহাজ (বাল্ক ক্যারিয়ার) তৈরির লক্ষ্য নিয়েছে, তবে এতগুলো জাহাজ তৈরিতে অনেক বছর লাগবে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কেমন হবে?
কৃষিবাণিজ্যের পরামর্শক সংস্থা এগরিসোর্সের প্রতিষ্ঠাতা ড্যান বাসি বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা চলে যাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রাশিয়ার কৃষকরা। কারণ, বাজারে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমা মানে, প্রতিযোগিতাও কমা।
আন্তর্জাতিক কৃষি সংস্থাগুলো না থাকায়, রাশিয়ার রপ্তানিমূল্য বৈশ্বিক গম বাজারের নির্ণায়ক সূচক হিসেবে থাকবে কিনা– সেটাও এই মুহূর্তে অস্পষ্ট।
বাসি বলেন, "যদি এই বাণিজ্য আরো বেশি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে, তাহলে আমাদের আস্থা কমবে, এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাবও থাকবে। এখানে মূল পরাজয়টা হবে বৈশ্বিক শস্য বাণিজ্যের।"