৫০ বছর আগেও ভারতে বাঘ ছিল প্রায় বিপন্ন, এখন বাড়ছে বাঘের সংখ্যা!
১৯৭০ এর দশকের দিকে ভারতে বাঘের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশটির স্বাধীনতা লাভের সময়ে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। ১৯৭০ সালে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ১৮০০-তে। আশঙ্কাজনকহারে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় দেশটির সরকারের কাছে ঘটনাটি বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করে। কেননা খাদ্যজালের একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থিত এ প্রাণীটি পরিবেশের জটিল বাস্তুসংস্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৭২ সালে 'প্রজেক্ট টাইগার' নামের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ভারত সরকার। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের।
গত রবিবার ভারতের পক্ষ থেকে বাঘ সংরক্ষণের জন্য নেয়া 'প্রজেক্ট টাইগার' এর ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রজেক্টটি বেশ সফলতা অর্জন করেছে। গত কয়েক দশকে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৩,১৬৭টিতে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, পূর্ববর্তী শুমারি থেকে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা প্রায় ২০০ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এর আগে ২০১৮ সালে করা বাঘশুমারিতে গত চার বছরের সময় অপেক্ষা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে ধীরগতি ছিল। তবে ভারতে সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত কখনও ধীরে কিংবা কখনও দ্রুত বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাঘশুমারি প্রকাশের ঠিক আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকের বনে দীর্ঘ ১২ মাইল পথ ভ্রমণ করেছেন। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তিনি সরকারের সংরক্ষণশীল কার্যক্রম ও জনসাধারণের সহযোগিতার কথা বলেন। একইসাথে নরেন্দ্র মোদি ভারতকে বিশ্বে বাঘের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র হিসেবেও উল্লেখ করেন।
বিশ্লেষক ও বন কর্মকর্তাদের মতে, গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা তুলনামূলক কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ঔপনিবেশিক মানসিকতার উচ্চশ্রেণীর মানুষের বাঘ শিকারের প্রবণতা। চর্চাটিকে অনেকটা আভিজাত্যের পরিচায়ক হিসেবে মনে করা হতো। এই অনুশীলনের কারণে ভারত থেকে চিতা সম্পূর্ণরূপেই বিপন্ন হয়ে যায়।
ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ার সাবেক ডিন ইয়াদভেন্দ্রাদেব ঝালা প্রায় দুই দশক ভারতের বাঘ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সময়টি ভারতের বন্যপ্রাণী ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। যদি 'প্রজেক্ট টাইগার' উদ্যোগটি না নেওয়া হতো, তবে নিঃসন্দেহে ভারত থেকে এতদিনে বাঘ বিপন্ন হয়ে যেত।"
বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে বেশ কয়েকটি উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। বাঘের বাসস্থান নিরাপদে রাখার জন্য গ্রামবাসীকে বন থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া, নিরপেক্ষ এলাকা তৈরি ও বনের পরিবেশ বাঘের জন্য অনুকূলে আনা এর মধ্যে অন্যতম।
১৯৭২ সালে যখন 'প্রজেক্ট টাইগার' গ্রহণ করা হয়েছিল, তখন ৫,৪০৫ বর্গ মাইল এলাকাজুড়ে মাত্র ৯টি এলাকা বাঘের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছিল। ৫ দশক পর বর্তমানে ভারতের ১৮টি রাজ্যজুড়ে মোট ৫৩টি সংরক্ষিত এলাকা বাঘের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। সর্বমোট ২৮,৯৫৮ বর্গমাইলের এ অঞ্চলগুলো ভারতের মোট এলাকার প্রায় ২ দশমিক ৩ ভাগ।
খাদ্য সংগ্রহ ও ঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য বাঘের দরকার বিস্তীর্ণ বিচরণভূমি। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাঘের স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্য প্রায় ২৭ থেকে ৩৯ বর্গ মাইল জায়গার প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ভারতের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ কোটি। তখন বনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাসস্থান না থাকায় দেশটিতে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। আর বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, এমতাবস্থায় ভারতে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার বাঘের বসবাস সম্ভব।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়ত দেশটিতে মানুষের বাসস্থানের এলাকায় বাঘ ঢুকে পড়ছে। এর ফলে বনের পাশে থাকা গ্রামবাসীদের মনে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বনের পাশে থাকা কৃষকেরা তাদের ফসলি জমিতে যেতেও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
২০১৮ সালে ভারতের পশ্চিমের রাজ্য মহারাষ্ট্রে টি১ নামের একটি বাঘকে পেশাদার শিকারি দিয়ে গুলি করে হত্যা করতে হয়। কেননা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা যায়, বাঘটি রাজ্যের ইয়াভাটমাল জেলার বেশ কয়েকজন মানুষকে খুবই মারাত্মকভাবে আহত করেছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক নজরদারি করা হলেও শিকার, বিষক্রিয়া এবং বৈদ্যুতিক আঘাতসহ নানা কারণে ভারতে বহু বাঘ মারা যাচ্ছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ৫৪৭টি বাঘ মারা গিয়েছে। এর মধ্যে ১৫৪টি বাঘের মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ৮৮টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে শিকারের কারণে।
তবে ভারতে বাঘের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন দেশটি বাঘ রপ্তানির কথা ভাবছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার সাথে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কম্বোডিয়ার ক্রমাগত শিকারের কারণে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভারত থেকে বাঘ আমদানির কথা চিন্তা করছে দেশটি।
অন্যদিকে দেশে চিতার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে ভারত আফ্রিকা মহাদেশের দেশ থেকে প্রায় ২০টি চিতা এনেছে। আমদানি করা এসব চিতার মধ্যে স্বাস্থ্যজনিত কারণে একটি চিতা মারা গিয়েছে। অন্যদিকে আরেকটি চিতা সম্প্রতি চারটি শাবক জন্ম দিয়েছে।
এ সম্পর্কে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, "কয়েক দশক ধরে ভারতে চিতার কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া থেকে বেশ কয়েকটি চিতা দেশে এনেছি। কিছুদিন আগে কুনো ন্যাশনাল পার্কে চারটি ফুটফুটে শাবক জন্ম নিয়েছে। দীর্ঘ ৭৫ বছর পর ভারতের মাটিতে চিতার জন্ম হয়েছে। এটা খুবই ভালো একটা সূচনা।"