শ্রীলঙ্কার পর এবার ফসল অনিষ্টকারী বানর রপ্তানি করতে চায় নেপাল
চলতি মাসের শুরুর দিক থেকে ফসল অনিষ্টকারী 'টক ম্যাকাক' জাতের ১ লাখ বানর চীনে রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনা করছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এবার শ্রীলঙ্কার পর একই পথে হাঁটতে যাচ্ছে নেপাল। দেশটিতে ফসল অনিষ্টকারী 'রেসাস ম্যাকাক' জাতের বানর রপ্তানি নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। খবর স্ক্রলের।
ফসলের ক্ষতি কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশটি থেকে 'রেসাস ম্যাকাক' জাতের বানর রপ্তানির দাবি জানিয়েছেন নেপালি কংগ্রেস পার্টির সংসদ সদস্য ধনরাজ গুরুং। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে এ সংক্রান্ত বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
ধনরাজ বলেন, "গ্রামে গ্রামে বানর নিয়ে ভীতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে হলেও বানর রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক হবে।"
'রেসাস ম্যাকাক' জাতের বানরের জন্য দেশটিতে কৃষকদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বহু পাহারা দিয়েও যেন খাদ্য ও ফসল বানরের অনিষ্ট করা থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের শহর পোখারার কৃষক রাম প্রাসাদ তিমসিনা বলেন, "মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আমরা নিজেদের জন্য নয় বরং বানরের খাবার যোগাড়ের জন্য চাষাবাদ করছি। এমনকি আমরা একা থাকলে বানরগুলো আমাদের উপর আক্রমণ করতেও ভয় পায় না।"
কৃষক থেকে শুরু করে সরকারি পর্যায়ে ফসলের জমিতে বানরের দৌরাত্ম্য মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বহু আগে থেকেই বেশ জোরেশোরে দাবি উঠেছে।
যদিও বানর রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনার জন্য শ্রীলঙ্কান সরকারকে বেশ সমালোচনা মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি বিতর্কের মুখে দেশটিতে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে বানর আমদানির সাথে চীন সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও জানানো হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে দেশটির কৃষিমন্ত্রী আমারাউইরা জানান, অনুরোধটি একটি প্রাইভেট কোম্পানির পক্ষ থেকে এসেছে এবং বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রীসভায় আলোচনা করা হবে। তবে বিতর্কের মুখে বানর রপ্তানির বিষয়টি থেকে সরে আসতে পারে শ্রীলঙ্কান সরকার।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বানর রপ্তানি করে এই সমস্যার সমাধান করা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা এক্ষেত্রে আইন, নৈতিকতা ও পরিবেশগত দিকটি সচেতনতার সাথে বিবেচনা করতে হবে।
নেপাল 'কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পিসিস' এর স্বাক্ষরকারী দেশ। এই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী 'রেসাস ম্যাকাক' জাতের বানরটি আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারে তীব্র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এছাড়াও দেশটির 'ন্যাশনাল পার্ক এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন এক্ট' অনুযায়ী, বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সরকারের অনুমতি ছাড়া রপ্তানি করা যাবে না।
২০০৪ সালে নেপাল বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটি নামের একটি বেসরকারি সংস্থা 'রেসাস ম্যাকাক' জাতের বানরটির উপর গবেষণার জন্য একটি সেন্টার তৈরির অনুমতি পায়। সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে তৎকালীন সময় প্রায় ৬৯ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ২০০টি বানর সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে সেগুলো থেকে নতুন জন্ম নেওয়া ২৫টি বানর সেন্টারটি রপ্তানি করতে চেয়েছিল।
কিন্তু প্রাণী অধিকার কর্মী ও সংরক্ষণবাদীরা সেন্টারটির বানর রপ্তানির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দায়ের করে। এমনকি বানরগুলোকে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যবহার করার বৈধতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। শেষমেশ সরকার নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে কোম্পানিটির লাইসেন্স বাতিল করে এবং ল্যাবের বানরগুলোকে মুক্ত করে দেয়।
অন্যদিকে প্রাইমেটোলজিস্ট মুকেশ কুমার মনে করেন, নীতিগতভাবে আমদানিকারক দেশ ও নেপাল; দুই দেশের জন্যই বানর রপ্তানির সিদ্ধান্ত লাভজনক হবে। কেননা চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশেই বায়োমেডিক্যাল রিসার্চে বানরের বেশ চাহিদা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এইডস, হেপাটাইটিস, টিউবারকুলোসিস, ম্যালারিয়ায় মতো মরণঘাতী রোগের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করা হয়।
তবে মুকেশ কুমার মনে করেন ফসলের ক্ষতি দমনে বানর রপ্তানিই একমাত্র সমাধান হতে পারে না। তিনি বলেন, "সমস্যাটি সমাধানে আমাদের একটি সামগ্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমে দেশব্যাপী রেসাস ম্যাকাক নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এরপর স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এরমধ্যে বানরের খাবার হিসেবে অপছন্দনীয় ফসলের চাষ বৃদ্ধি, ক্ষতিকারক বানরগুলোকে শনাক্ত করা ও বনে ফলগাছের পরিমাণ বৃদ্ধি অন্যতম।"
অন্যদিকে সংরক্ষণবাদী সাবিনা কৈরালা মনে করেন, প্রকট আকার ধারণ করা এ সমস্যাটি নিয়ে চটজলদি সমাধানের পথ না খুঁজে বরং মূল সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন, বানরের বাসস্থানের অভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনের জমি দখল ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
সাবিনা কৈরালা বলেন, "সরকারি উদ্যোগে বনে যেসব গাছপালা লাগানো হয় সেগুলো বানর থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে না। যার ফলে খাবারের অভাবে বন্যপ্রাণী ফসলি জমিতে চলে আসে।"
আরেক সংরক্ষণবাদী কুমার পডেল মনে করেন, অর্থের জন্য বানর রপ্তানির এ পদক্ষেপটি মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেবে।
তিনি বলেন, "এটা খুবই আশঙ্কাজনক যে, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পর্যন্ত বানর রপ্তানির প্রভাব বিবেচনা না করে এ সংক্রান্ত আলোচনা করছেন। আমরা যদি রপ্তানি করে অর্থ আয় করতেই চাই তবে কেন টমেটো কিংবা সবজি রপ্তানি করছি না?"