ফসল অনিষ্টকারী এক লাখ বানর চীনে পাঠাতে চায় শ্রীলঙ্কা, আপত্তি তুলছে পরিবেশবাদীরা
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কান সরকারের কাছে ফসল অনিষ্টকারী 'টক ম্যাকাক' জাতের ১ লাখ বানর আমদানির অনুরোধ জানিয়েছে একটি চীনা কোম্পানি। শ্রীলঙ্কা থেকে চীনে এত বিপুল সংখ্যক বানর পাঠানোর পরিকল্পনাকে 'বন্যপ্রাণী শোষণ' হিসেবে আখ্যায়িত করে আপত্তি তুলছে পরিবেশবাদীরা। খবর স্ক্রলের।
শ্রীলঙ্কায় বন্য প্রাণীর কারণে ফসল নষ্টের ঘটনা প্রায়শই শোনা যায়। ২০২২ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরের প্রথম ভাগে বন্যপ্রাণীর ফলে প্রায় ৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ফসল নষ্ট হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় যেসব বন্য প্রাণী ফসলের অনিষ্ট করে থাকে তাদের মধ্যে টক ম্যাকাক জাতের বানর অন্যতম। প্রাণীটি বিশেষ করে নারকেলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে।
এ সমস্যা সমাধানের অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার কৃষি মন্ত্রী মাহিন্দা আমারাউইরা প্রকাশিত এক বিবৃতিতে চীনা কোম্পানির ১ লাখ বানর আমদানির ইচ্ছা প্রকাশের খবরটির জানানো হয়। তথ্যটি প্রকাশের পরই প্রাণী অধিকার কর্মী এবং পরিবেশবাদীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কার সরকার।
প্রাণী অধিকার কর্মী পাঞ্চালি পানাপিটিয়া বলেন, "কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বানরগুলো চীনের চিড়িয়াখানার রাখার জন্য আমদানি করা হবে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক বানরকে রাখার সক্ষমতা খুব কম চিড়িয়াখানারই রয়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি যে, এটা হয়তো আসল উদ্দেশ্য নয়। বানরগুলোকে মেডিক্যাল রিসার্চের কাজে ব্যবহার করা হতে পারে।"
পানাপিটিয়া আরও জানান, চীনের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বানরের মাংসকে সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কান বানরগুলোকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সন্দেহের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায় যখন চীনে গবেষণায় জন্য ব্যবহার করা বানরের সংকট রয়েছে বলে সম্প্রতি কিছু খবর প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ইতোমধ্যেই পাকিস্তান থেকে খাদ্য হিসেবে চীন গাধা ও কুকুর আমদানি করছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বানর আমদানির সাথে চীন সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী আমারাউইরা জানান, অনুরোধটি একটি প্রাইভেট কোম্পানির পক্ষ থেকে এসেছে এবং বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রীসভায় আলোচনা করা হবে।
আমারাউইরা বলেন, "ম্যাকাক জাতের বানরগুলো ফসলের তীব্র ক্ষতি করে বিধায় আমাদের এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চীনা কোম্পানির অনুরোধের সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে আমরা এদের নিয়ন্ত্রণের কাজটি শুরু করতে পারি।"
শ্রীলঙ্কান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে প্রায় ৩০ লাখ ম্যাকাক বানর রয়েছে। যদিও সরকার ঘোষিত এ সংখ্যা নিয়ে সংরক্ষণবাদীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের লিড প্রাইমাটোলজিস্ট ওলফগ্যাং বলেন, "মন্ত্রী বানরের সংখ্যার যে দাবিটি করেছেন, তার পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনো রিপোর্ট নেই। ১৯৭৭ সালে টক ম্যাকাকের সংখ্যা নিয়ে কাজ করা হয়েছিল। ঐ গবেষণা অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে ম্যাকাকের সংখ্যা ছিল ৬ লাখেরও কম।"
১৯৭৭ সালে করা সার্ভেতে দেখা যায়, মোটাদাগে ম্যাকাক বানরগুলো শুষ্ক অঞ্চল, আর্দ্র অঞ্চল ও উঁচু ভূমির অঞ্চলে বসবাস করে থাকে। কিন্তু এরপর থেকে সময়ের সাথে সাথে এসব অঞ্চলগুলোতে বানরের স্বাভাবিক বাসস্থান ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানান ওলফগ্যাং।
যেসব অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছে ও পর্যটক আসার পরিমাণ বেড়েছে সেসব অঞ্চলে বানরের খাদ্যের উৎসও বেড়ে গিয়েছে। ফলে গত ৩০ থেকে ৫০ বছরে শুধু সেসব নির্দিষ্ট অঞ্চলে বানরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে এ সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু ঐ নির্দিষ্ট এলাকার ক্ষেত্রেই সত্য, ভৌগলিকভাবে বৃহত্তর এলাকার ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। উদ্ভুত এ পরিস্থিতির দুটি নেতিবাচক দিক রয়েছে।
প্রথমত, নির্দিষ্ট অঞ্চলে বানরের সংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পেলে মানুষের সাথে প্রাণীটির দ্বন্দ্বের পরিমাণ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সর্বোপরি বানরের সংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাপারটিও নজরে আসবে না।
২০২১ সালে সেন্টার ফর কনজারভেশন এন্ড রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার ৮০ ভাগ এলাকায় ছড়িয়ে আছে টক ম্যাকাক জাতের বানর। গবেষণা দলের প্রধান জেনিফার পাস্তরিনি জানান, গবেষণাটি প্রশ্নমালা নির্ধারণ করে সার্ভে আকারে সম্পন্ন করা হয়েছে।
গবেষণায় বানরটি কোন কোন এলাকায় কী পরিমাণে রয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। প্রাণীটি নিয়ে তাই আরও বিশদভাবে জানার জন্য অধিকতর গবেষণার পরামর্শ দেন পাস্তরিনি।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) ইতোমধ্যেই ম্যাকাক বানরকে 'বিপন্ন' প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা সরকারের ২০১২ সালের তালিকায় ম্যাকাককে 'কম সংকটাপন্ন' প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণীটি নিয়ে চলমান অধিকতর পর্যবেক্ষণের সাথে সম্পৃক্ত ওলফগ্যাং জানান, বানরটি বর্তমানে অনেকটা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
আইইউসিএন এর স্পিসিস সারভাইভাল কমিশনের সাবেক সহকারী প্রধান পরিবেশবিদ রোহান পেথিয়াগোদা বলেন, "কারণ যাই হোক না কেন, বানর পাঠানোর সিদ্ধান্তটি ভালো কোনো আইডিয়া নয়। দেশে জীবন্ত প্রাণী রপ্তানি করার কোনো আইনি বিধানও নেই।" একইসাথে এমন সিদ্ধান্ত বিবেচনার জন্য শ্রীলঙ্কার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
অন্যদিকে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ডিপার্টমেন্টের সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল সুমিথ পিলাপিটিয়া বলেন, "মানুষ ও বানরের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব সমসাময়িক সময়ে প্রকট হয়েছে। সমস্যাটি সমাধানে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকারের উচিত সমাধানে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা।"
অন্যদিকে স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দারা বানর পাঠানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। পডুজানা ফার্মারস এসোসিয়েশনের প্রধান রাজাকারুনা বলেন, "ম্যাকাক বানরগুলো ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে তারা। তাই বানর যে দেশেই রপ্তানি করা হোক না কেন, আমাদের তা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই।"
অন্যদিকে বানর পাঠানোর বিরোধিতা করা পরিবেশবাদী ও সংরক্ষণবাদীদের উল্টো সমালোচনা করেছেন রাজাকারুনা। তাদের মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা ও ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দূর থেকে ভালো ভালো কথা বলা সহজ। কিন্তু বানরের সংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে যারা ভুক্তভোগী, শুধু তারাই জানে পরিস্থিতি কতটা দুর্বিষহ।"
শেষ পর্যন্ত বানর রপ্তানি করা হবে কি-না সেটি নিশ্চিত নয়। তবে শ্রীলঙ্কার কৃষি মন্ত্রণালয় ম্যাককের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। এক্ষেত্রে কিছু দেশ সংখ্যায় অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর অল্প কিছু সংখ্যাককে পরিকল্পনামাফিক মেরে ফেলে মোট সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি বছর ক্যাঙ্গারুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে শ্রীলঙ্কার মতো দেশে বানরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সার্বিক দিক বিবেচনায় এ পদ্ধতি কার্যকরী হবে কি-না, সেই শঙ্কা থেকেই যায়।
তবে এ পদ্ধতিতে বানর শিকার করে কিংবা মেরে ফেলে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে শ্রীলঙ্কার জনগণ সমর্থন করবে না বলে মনে করেন পেথিয়াগোদা। তিনি বলেন, "সমস্যার একটিই সমাধান রয়েছে। সেটি হলো, নিজ নিজ জায়গা থেকে ফসল রক্ষার চেষ্টা করা এবং সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া।"