পাঠ্যবই: কেন ভারতীয় লেখকরা নিজেদের লেখা বই অস্বীকার করতে চাইছেন?
সম্প্রতি ভারতে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় বাদ দেওয়ার পর, শিক্ষার্থীদের কি কি পড়ানো উচিত তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে বিতর্কের ঝড়। 'একটি পাঠ্যবই আসলে কার?' এ প্রশ্নটিই এখন মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর বিবিসির।
পাঠ্যবইগুলো অবশ্য নতুন নয়- কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং (এনসিইআরটি) চলতি বছরে বইগুলো প্রকাশ করেছে এবং ভারতের ২০ হাজারের বেশি স্কুলে ইতোমধ্যেই বইগুলো পড়ানো হচ্ছে। সরকার পরিচালিত সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের অধীনে এনসিইআরটি শিশুদের পরীক্ষার জন্য পাঠ্যক্রম পরিবর্তন এবং পাঠ্যপুস্তকে কী কী বিষয় থাকবে তা তদারকি করে।
বাদ দেওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী কর্তৃক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা, ফেডারেলিজম এবং 'গণতন্ত্র ও বৈচিত্র্য' নিয়ে লেখা অধ্যায়গুলো।
এছাড়াও, এনসিইআরটি পাঠ্যবই থেকে ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গা, ভারতে মোগল শাসকদের ওপর একটি অধ্যায়, পর্যায় সারণির অধ্যায় এবং দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বই থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বাদ দিয়ে দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
এনসিইআরটি বলেছে, পাঠ্যক্রমকে 'যৌক্তিকীকরণ' প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এসব পরিবর্তন আনার বিষয়ে গত বছরই প্রথম ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এ পরিবর্তনের ফলে শিশুদের জ্ঞান আহরণে কোনও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। বরং কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী সময়ে শিশুদের ওপর চাপ কমিয়ে আনবে এ পদক্ষেপ।
কিন্তু পুরনো পাঠ্যবইগুলো তৈরি এবং এর মানোন্নয়নের জন্য গঠিত কমিটিতে যেসব শিক্ষাবিদরা ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ চাইছেন না যে, নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তাদের নাম জড়িত থাকুক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুহাস পালশিকার ও যোগেন্দ্র যাদব ২০০৬ সালে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইগুলো প্রকাশনায় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। তারা দুজনই গত ৮ জুন পাঠ্যবইগুলোর নতুন মুদ্রিত ও ডিজিটাল সংস্করণ থেকে তাদের নাম সরিয়ে নেওয়ার জন্য এনসিইআরটি'কে চিঠি দিয়েছেন।
এই শিক্ষাবিদরা বলছেন, তারা পাঠ্যপুস্তক থেকে 'অসংখ্য বিষয় অযৌক্তিকভাবে কাটছাঁট করা ও বাদ দেওয়া' নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন, কারণ এসব পরিবর্তনের পেছনে শিক্ষার স্বার্থ সংক্রান্ত কোনো যুক্তি তারা খুঁজে পাননি।
অন্যদিকে, এনসিইআরটি এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এ ধরনের অনুরোধ রাখার 'কোনো প্রশ্নই আসে না', কারণ প্রকাশিত সকল বিষয়ের কপিরাইট শুধুমাত্র এনসিইআরটি'র। এ বিষয়ে বিবিসি'র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে, এনসিইআরটি'র পরিচালক ডিএস সাকলানি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতির দিকেই বিবিসির মনোযোগ আকৃষ্ট করেন।
তবে গত সপ্তাহে ৩০ জনেরও বেশি শিক্ষাবিদ বইয়ে তালিকাভুক্ত পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন কমিটি (টিডিসি) থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করার জন্য এনসিইআরটি'কে চিঠি দেওয়ার পর অচলাবস্থা আরও তীব্র হয়েছে। এসব পণ্ডিতদের যুক্তি, কপিরাইট থাকার মানে এই নয় যে এনসিইআরটি তাদের লেখা পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনতে পারবে।
কিন্তু এনসিইআরটি বলছে, "টিডিসি'র ভূমিকা হলো শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক ডিজাইন এবং এর মানোন্নয়নে পরামর্শ দেওয়া কিংবা পাঠ্যবইয়ের আধেয়গুলো পরিবর্ধনে অবদান রাখা; এর বেশি কিছু নয়।"
এনসিইআরটি আরও জানিয়েছে, 'যৌক্তিকীকরণ' করা কন্টেন্টগুলো শুধুমাত্র বর্তমান শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রযোজ্য এবং নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে তৈরি নির্দেশিকার উপর ভিত্তি করে শীঘ্রই নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হবে।
এদিকে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক শিক্ষাবিদদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, পাঠ্যবই আত্মদর্শনের একটি উৎস হওয়া উচিত; তারা এনসিইআরটি'র বিরুদ্ধে এমন সব বিষয়ে মুছে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন, যে বিষয়গুলো আসলে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য প্রীতিকর নয়।
"পাঠ্যক্রমকে 'যৌক্তিকীকরণ' করার সিদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত হয় যে এনসিইআরটি তাদের স্বায়ত্তশাসনের মূল্য দেয় না, কিংবা তাদের নেতৃত্ব গণতন্ত্রে এর অবস্থান বোঝে না", মন্তব্য করেন নাম প্রত্যাহারের জন্য এনসিইআরটিকে চিঠি দেওয়া শিক্ষাবিদ পিটার রোনাল্ড ডি সুজা।
কিন্তু একই প্রেক্ষাপটে কারো কারো কাছ থেকে সমর্থনও পেয়েছে এনসিইআরটি। গত সপ্তাহে ৭৩ জন শিক্ষাবিদ এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক হালনাগাদ করার প্রয়োজন ছিল।
"সমালোচকদের দাবি অনুযায়ী, তারা চান যে শিক্ষার্থীরা আধুনিক পাঠ্যবই নয়, বরং ১৭ বছরের পুরনো পাঠ্যবই দিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যাক। তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তারা দেশের কোটি কোটি শিশুর ভবিষ্যত নষ্ট করতে প্রস্তুত", বলেন এই শিক্ষাবিদরা।
এনসিইআরটি'র সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সমর্থনকারীদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) প্রধান এবং দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)-এর প্রধান।
জেএনইউ'র ভাইস চ্যান্সেলর সান্তিশ্রী ধুলিপুরি পণ্ডিত লিখেছেন, "তদন্তের প্রশংসা করা উচিত যতক্ষণ পর্যন্ত এটি সঠিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হয়। সিলেক্টিভ পড়াশোনা এবং ভুল চরিত্রায়ন স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার জন্ম দেয় না, বরং এর অবমূল্যায়ন করে।" তিনি আরও বলেন, এই ইস্যুতে 'যাচাই করা হয়নি এমন অনেক তথ্য' প্রচার করেছে গণমাধ্যম।
ভারতে পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে বিভিন্ন সরকার প্রায়ই তাদের মতাদর্শিক বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যবইয়ে নতুন কিছু প্রবর্তন বা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অধিকাংশ পণ্ডিতই তথ্য হালনাগাদ করতে এবং পাঠের বিষয়বস্তু ও অধ্যয়নের পর শিক্ষার্থীরা কী জ্ঞানার্জন করলো, এই দুটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে নিয়মিত বইগুলো পর্যালোচনার পরামর্শ দেন।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এই পর্যালোচনা স্বচ্ছতার সাথে এবং সামগ্রিক বিবেচনায় করা উচিত।
"একটি শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবইকে সবচেয়ে শুদ্ধ মনে করা হয়। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় নিয়ে জানার প্রথম নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে পাঠ্যবইকে বেছে নেয়", বলেন পালশিকার।
এনসিইআরটি'র পাঠ্যবইগুলো নিয়ে প্রচুর যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, কারণ ভারতের হাজার হাজার স্কুল শিক্ষার্থী এই বইগুলো ব্যবহার করে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরাও তথ্যসূত্রের জন্য এই বইগুলো ব্যবহার করেন। "তাই এই বইগুলোর 'ক্যাচমেন্ট এরিয়া' অনেক বড়", বলেন পালশিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষতার সাথে তৈরি যেকোনো পাঠ্যক্রমের ভূমিকা হলো- শিক্ষার্থীদের এমন সব বিষয়ে জানার সুযোগ দেওয়া যেগুলো আলোচনার জন্ম দেয়, তাদেরকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি করে যা শুধুমাত্র পাঠ্যক্রমের সাথেই নয়, তাদের জীবনের সাথেও জড়িত।
কিন্তু যখন 'কিছু অনুচ্ছেদ ও বাক্য নির্বিচারে মুছে ফেলা হয়', তখন পাঠ্যবইয়ের সেই যুক্তির ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায়, যা শেখার প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে, বলেন পালশিকার।
তিনি আরও যোগ করেন, তারা বর্তমানে পাঠ্যবই থেকে বিভিন্ন বিষয় বাদ দেওয়ার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছেন কারণ এনসিইআরটি'র আলোচনার প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল তা স্পষ্ট নয়।
"আমাদের একমাত্র অভিযোগ হলো- আপনারা যদি অন্য কারো পরামর্শ নিয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের নাম সরিয়ে তাদের নাম দিন বইতে", বলেন তিনি।
যেসব বই নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে এনসিইআরটি বলছে: তাদের অভ্যন্তরীণ ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং বাইরে থেকে আগত বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী তারা বইগুলোতে পরিবর্তন এনেছে।
পাঠ্যক্রম 'যৌক্তিকীকরণ' প্রক্রিয়ায় এনসিইআরটি'র ফ্যাকাল্টি সদস্য ও বিশেষজ্ঞরা পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় এনেছেন: "প্রথমত, একই শ্রেণীতে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কন্টেন্টের পুনরাবৃত্তি; দ্বিতীয়ত, উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীতে একই বিষয়ের ওপর একই কন্টেন্ট চলে আসা; তৃতীয়ত, যা পড়ানো হচ্ছে তা কতটা কঠিন; চতুর্থত, এমন কন্টেন্ট রাখা যা শিশুরা সহজে বুঝতে পারে এবং 'শিক্ষকদের খুব বেশি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না'; পঞ্চমত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক নয় এমন কন্টেন্ট।"
সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে কাউন্সিলের টেক্সটবুক টিমের চারজন সদস্য লিখেছেন, "যেসব তথ্য পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বা 'যৌক্তিকীকরণ' করা হয়েছে- 'হয় সেগুলো বিভিন্ন শ্রেণীর একই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর নাহয় একই শ্রেণীতে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল"।
তাই তাদের ভাষ্যমতে, নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে পর্যায় সারণী পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়নি, বরং তা পুনরায় একাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। মোগলদের ইতিহাসও পাঠ্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়নি। আর ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
জেএনইউ'র ভিসি লিখেছেন, "কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই অ্যাবসলিউট নয়- সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সাম্প্রতিক যেসব বিতর্কে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেগুলোও পাঠ্যক্রমের অংশ হওয়া উচিত।"
তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ ধরনের 'স্বেচ্ছাচারী' পরিবর্তন ভালোর চাইতে বরং খারাপই বয়ে আনে বেশি।
ইউজিসির চীফ মামিডালা জগদেশ কুমার, যিনি পাঠ্যক্রম যৌক্তিকীকরণকে সমর্থন দিয়েছেন, তিনিও কিছু কিছু সমালোচনার সঙ্গে একমত- বিশেষ করে বিজ্ঞান পড়ানোর বিষয়ে।
চলতি সপ্তাহে তিনি লেখেন, "বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাধারণত দশম শ্রেণী শেষ করার আগেই বিবর্তনবাদ, পর্যায় সারণি ও শক্তির উৎস'র মতো বিষয়গুলো পড়ানো হয়।" তবে তিনি এও লেখেন যে, এনসিইআরটি'র উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ নেই।
শিক্ষাবিদ পালশিকার বলেন, "আমার মনে হয়, চাকরি লাভের চাপে ভারতে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা বহুদিন ধরেই তার মান হারিয়েছে। উচ্চশিক্ষার যে মৌলিক উদ্দেশ্য- প্রশ্ন করা ও জ্ঞান অন্বেষণ, তা হারিয়ে গেছে। সেই তুলনায় আমরা এখন খুবই ছোট বিষয় নিয়ে বিতর্কের মধ্যে রয়েছি।"