রাশিয়ার মিসাইলভান্ডার শেষ হয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা অবাস্তব: মার্কিন থিংক ট্যাংক
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এক পর্যায়ে অনেকে রাশিয়ার অস্ত্রভান্ডার নিয়ে নানা সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। রাশিয়া আর কতদিন যুদ্ধ করতে পারবে, ক্রেমলিনের মিসাইলের মজুত কি শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে — এ ধরনের অনেক প্রশ্নই তৈরি হয়েছিল। এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন, বিশ্লেষণও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক জানিয়েছে, ইউক্রেনে 'সামরিক অভিযানের জন্য' রাশিয়ার মিসাইলের মজুত শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রাশিয়ার মিসাইল শেষ হয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা করাটাই পুরোপুরি অবাস্তব হবে'। থিংক ট্যাংকটির ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরটি প্রোগ্রাম-এর ফেলো এবং মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্ট-এর উপ-পরিচালক ইয়ান উইলিয়ামস ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, 'নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ' সত্ত্বেও ভবিষ্যতে ইউক্রেনের জনগণ, অর্থনীতি, ও সামরিক সক্ষমতার বড় ধরনের ক্ষতি করার জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘপাল্লার মিসাইল তৈরি বা কেনার সক্ষমতা মস্কোর রয়েছে।
ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর থেকেই রাশিয়া নিয়মিত দেশটিতে মিসাইল হামলা শুরু করে। ইউক্রেনের অর্থনীতি, অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে এ হামলাগুলো।
পশ্চিমাদের দেওয়া আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে রাশিয়ার মিসাইল হামলাগুলো অনেকাংশেই ঠেকিয়েছে ইউক্রেন। কিন্তু রাশিয়া নিয়মিত এর হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে। ফলে দেশটির মিসাইল মজুত শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
এরপর রাশিয়ান ইরান থেকে কামিকাজে ড্রোন শাহেদ সংগ্রহ করে ইউক্রেনের ওপর ব্যবহার শুরু করলে এ সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। তখন মনে করা হয়েছিল, রাশিয়ার যুদ্ধকৌশলের এ পরিবর্তনের কারণ এর মিসাইলের ভান্ডার ক্রমশ হ্রাস পাওয়া।
২০২২ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছিল, মার্কিন কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে রাশিয়ার সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারযোগ্য গোলাবারুদের ভান্ডার শেষ হয়ে যাবে। রাশিয়াও তখন নিখুঁত লক্ষ্যভেদী মিসাইলের পরিবর্তে সোভিয়েতযুগের মিসাইল ও গোলাবারুদ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এ মিসাইলগুলো লক্ষ্যবস্তুতে শতভাগ নির্ভুলভাবে আঘাত না হানলেও এগুলোর প্রবল বিধ্বংসীক্ষমতা ছিল।
এছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর একজন মুখপাত্র দেশটির গোয়েন্দাসংস্থার বরাত দিয়ে দাবি করেছিলেন, রাশিয়ার কাছে ১০০টিরও কম ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। ওই সময় রাশিয়া এস-৩০০ ও এস-৪০০ মিসাইলের ব্যবহার বেশি করছিল। ফলে তাদের ইস্কান্দারের মতো নিখুঁত লক্ষ্যভেদী মিসাইলসংখ্যা কমে যাওয়ার ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়।
এ বছরের মে মাসে সামরিক বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার সদ্য-তৈরি মিসাইল ইউক্রেনে ব্যবহারের বিভিন্ন প্রমাণ পান। তখন ইউক্রেন দাবি করেছিল, রাশিয়ার মিসাইলের মজুত এতই কমে গিয়েছে যে এটি বাধ্য হয়ে নতুন মিসাইল তৈরির কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করছে।
তবে 'রাশিয়া ইজন্ট গোয়িং টু রান আউট অভ মিসাইলস' শীর্ষক সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, রপ্তানি বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার মিসাইল উৎপাদনে অভীষ্ট প্রভাব রাখতে পারেনি। 'নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হামলা করার অ্যাসেটের পরিমাণ ও মানে কিছুটা লাগাম টেনে ধরতে পারে সর্বোচ্চ,' বলা হয় সেখানে।
রাশিয়ার মিসাইলের ভান্ডার শেষ হয়ে গেছে এমন সন্দেহ সম্পর্কে সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুব সম্ভবত রাশিয়া ইউক্রেনে তার 'বিশেষ সামরিক অভিযানের' জন্য যেসব মিসাইল বরাদ্দ রেখেছিল. সেগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে সম্ভবত অন্য সামরিক উদ্দেশ্যে মজুত রাখা মিসাইল ব্যবহার করতে শুরু করেছে এটি।
রাশিয়া এটির ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য এবং জাহাজবিধ্বংসী বিভিন্ন মিসাইলকে ভূমিতে আঘাত হানার মতো উপযুক্ত করে পরিবর্তন করেছে। আর বিভিন্ন প্রমাণ থেকে সমরবিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, মস্কোর কাছে এ মুহূর্তে থাকা বেশিরভাগ (সম্ভবত সবগুলো) ক্রুজ মিসাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বানানো।
'তবে রাশিয়ার দীর্ঘপাল্লার হামলার মানের পতন যে সামনেও বজায় থাকবে, তার সম্ভাবনা প্রায় নেই।… তবে এটা অসম্ভব যে রাশিয়ার শক্তিশালী ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইলের উৎপাদন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে,' লেখেন ইয়ান উইলিয়ামস।
প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মাইক্রোইলেকট্রনিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও রাশিয়া মিত্র তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে এসব পশ্চিমাপণ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে আসা রাশিয়ান মিসাইলের ধ্বংসাবশেষ তা-ই প্রমাণ করে।
নিষেধাজ্ঞা ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কেবল রাশিয়ার মিসাইল উৎপাদন খরচ বাড়াতে এবং মিসাইলের সংখ্যায় প্রভাব রাখতে পারবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত রাশিয়ার মিসাইল তৈরির সক্ষমতা ও মিসাইল হামলা বজায় থাকবে, সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়।
গত বছরের তুলনায় এ বছরের মে মাসের পর থেকে রাশিয়া তার মিসাইল ও ড্রোনের লক্ষ্যবস্তুর পরিধি আরও বড় করেছে এবং এ লক্ষ্যবস্তু কী হবে তা নিয়ে আরও বেশি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষণ করেছেন প্রতিবেদনটির লেখক।
রিপোর্টটিতে বলা হয়, রাশিয়ার বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনকে এর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো শহর রক্ষায় নিয়োযিত করতে বাধ্য করা যাতে পালটা আক্রমণের সময় এটি ফ্রন্টলাইনে ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকে।
এছাড়া সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রশংসা করা হয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ান হামলা ঠেকাতে চমৎকার সফলতা দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় সেখানে।