পশ্চিম তীরে কেন বড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে ইসরায়েল?
পশ্চিম তীরে দুই দশকের মধ্যে বৃহত্তম সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে ইসরায়েল। এর অংশ হিসেবে জেনিন শহরে চালানো হয়েছে ড্রোন হামলা। যার ফলে শহরটিতে অবস্থিত শরণার্থী ক্যাম্পে অন্তত ৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।
জেনিনে গত রবিবার রাতে অন্তত ১০টি বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সর্বশেষ আক্রমণ শুরু হয়। জেনিন একটি জনবহুল অঞ্চল যেখানে মাত্র আধা বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ১৪ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী বাস করেন।
ইসরায়েলের আকাশপথে এ অভিযানের মধ্যে ড্রোন ছাড়াও ছিল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এতে করে জেনিনের বহু ভবন ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংসাবশেষ থেকে উড়তে দেখা গেছে ধোঁয়া।
গত ২১ জুন জেনিনের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায়ও বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। অথচ ২০০৬ সাল থেকে এতদিন পর্যন্ত ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ড্রোন হামলার ঘটনা দেখা যায়নি।
গতকাল (সোমবার) আকাশপথে হামলার পর ইসরায়েলি বাহিনী স্থলভাগে জেনিন শরণার্থী শিবিরে অভিযান পরিচালনা করে। তারই অংশ হিসেবে সাঁজোয়া যান দিয়ে শিবিরটি ঘিরে ফেলা হয়। এতে করে অঞ্চলটির বাড়িঘর ও রাস্তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ইসরায়েলি বাহিনীর সম্মিলিত এ অভিযানে প্রায় ১৫০ টি সাঁজোয়া যান, এলিট স্পেশাল ফোর্সের প্রায় ১ হাজার সৈন্য, পুলিশ, গোয়েন্দা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেয়। শহরটির প্রবেশমুখ ট্র্যাক্টর ব্যবহার করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে করে ইসরায়েলি সেনারা খুব সহজেই জেনিনে প্রবেশ করে।
ইসরায়েলি বাহিনী ক্যাম্পে প্রবেশের পর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। মূলত তারা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী যোদ্ধাদের ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়।
অন্যদিকে ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, তাদের বাড়িতে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। একইসাথে জেনিনের ডেপুটি গভর্নর কামাল আবু আল-রাব আল-জাজিরাকে জানান, ইসরায়েলি বাহিনী বাসিন্দাদের 'সম্মিলিত শাস্তি' প্রদানের অংশ হিসাবে অঞ্চলটির বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ এবং পানির সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে।
গতকালের হামলার বিষয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালক খালেদ আলহামেদ রয়টার্সকে বলেন, "জেনিন শিবিরে যা হচ্ছে, তা হলো আসল যুদ্ধ। ক্যাম্প লক্ষ্য করে আকাশ থেকে হামলা চালানো হচ্ছে। প্রতিবার আমরা পাঁচ থেকে সাতটি আম্বুলেন্স নিয়ে সেখানে যাচ্ছি, আর গাড়িভর্তি আহতদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছি।"
অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী যেন সময়ের সাথে সাথে অভিযানের মাত্রা বাড়াচ্ছে। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় জেনিন শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও পূর্বের তুলনায় আরও বেশি শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।
ইতোমধ্যে কয়েকশ যোদ্ধা নিয়ে 'জেনিন ব্রিগেড' নামের নতুন একটি গ্রুপও তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, জেনিনে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ, ফাতাহ ও হামাস গ্রুপের সদস্যরাও অঞ্চলটিতে সক্রিয় রয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে পশ্চিম তীরে অনেকটা জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে ইসরায়েল। আর এর প্রতিবাদে বিপুল পরিমাণ ফিলিস্তিনি তরুণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এখন শুধু গাজা ভূখণ্ডই নয়, বরং জেনিন শহরও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রধান প্রতীক হয়ে উঠেছে।
প্রতিরোধকামী উদীয়মান সংগঠন 'জেনিন ব্রিগেড' কে নির্মূল করতেই মূলত ইসরায়েলের বাহিনী গত বছর দুই ধরে পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান বৃদ্ধি করছে বলে ধারণা করা হয়। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনী এ সম্পর্কিত একটি অপারেশনও চালু করেছে; যার নাম 'ব্রেক দ্য ওয়েভ'।
সম্প্রতি এ হামলার পর ইসরায়েলী বাহিনীর পক্ষ থেকে জাননো হয়, তারা জেনিনে অবস্থিত একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা ও গোলাবারুদ মজুদ রাখা স্থানে হামলা করতে সমর্থ হয়েছে। তবে বাহিনীটি শুধু সদ্য ব্যবহৃত একটি রকেট লঞ্চার জব্দ করতে পেরেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, সোমবার সংগঠিত অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল 'শিবিরে অবস্থান করে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ের মানসিকতা ভেঙে ফেলা'।
ইসরাইয়েলি মুখপাত্র আরও জানান, বাহিনীটি বিশ্বাস করে যে, ক্রমবর্ধমান এ অভিযান 'সংঘর্ষের প্রবণতা' কমাতে সাহায্য করবে। একইসাথে ইসরায়েলি বাহিনী যেহেতু প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে, তাই সাথে অনুরূপ অভিযান সামনেও আরও পরিচালনা করা হবে।
গত মাসে জেনিনে অভিযান পরিচালনার সময় বহু ইসরায়েলি সৈন্য আহত হয়েছিল। একইসাথে তাৎক্ষণিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে বহু সেনা যান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। গত মাসে এমন বিরুপ পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলি বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
এমতবস্থায় স্থলভাগে আশানুরূপ সুবিধা করতে না পেরে ইসরায়েলি বাহিনীকে হেলিকপ্টার গানশিপের সাহায্য নিতে হয়েছিল। গত ২০ বছরে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে এমনটি আর ঘটেনি।
জেনিনসহ অন্য শহরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা গত এক বছরের বেশি সময়ে যেন অহরহ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একইসাথে এ হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকেও হামলা করা হচ্ছে। এমতবস্থায় সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনীর এ অভিযান সংঘাতের সম্ভবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে।
গত মাসে জেনিনে ইসরায়েলি হামলার জেরে দুই ফিলিস্তিনি বন্ধুকধারী বসতি স্থাপনকারী চার ইসরায়েলিকে গুলি করে হত্যা করে। আবার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের গ্রামে আচমকা হামলা করে। এমনকি গ্রামবাসীদের ঘর-বাড়ি, ফসল ও গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়।
অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েল সরকার আরও কয়েক হাজার নতুন বসতি স্থাপনের পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি অবৈধ হলেও ইসরায়েল সেটির তোয়াক্কা করছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের অতি-ডানপন্থী মন্ত্রীদের শান্ত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জেনিনে বড় আকারে এই অভিযান পরিচালনা করেছে। কেননা এই রাজনীতিবিদ দেশের বিরোধীদের কাছ থেকেও প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন।
অন্যদিকে চলমান এ সংঘাত ও ইসরায়েলের নতুন বসতি স্থাপনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইসরায়েলের প্রতি সংঘাত ও বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার জন্য বলা হয়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি অভিযানে ইসরায়েলের 'উন্নত সামরিক অস্ত্র' ব্যবহারের নিন্দা করেছে জাতিসংঘ। দখলকৃত অঞ্চলটিতে এ সহিংসতা 'নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার' ঝুঁকি রয়েছে বলেও সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে সতর্ক করা হয়েছে।