জেনিন থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর গাজায় বিমান হামলা চালালো ইসরায়েল
অধিকৃত পশ্চিম তীরে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ একটি সামরিক অভিযান শেষে মঙ্গলবার ফিলিস্তিনের জেনিন শহর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কিন্তু ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার শুরুর পরেই গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে লক্ষ্য করে রকেট ছোড়া হয়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। খবর রয়টার্স এর।
অন্যদিকে, দ্য টাইমস অব ইসরায়েল সূত্রে জানা যায়, বুধবার ভোরে গাজার দুটি স্থানে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, তাদের যুদ্ধবিমান একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্র নির্মাণ কারখানায় হামলা চালিয়েছে।
ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বিমান গাজা সিটির আল-বায়দার এবং বাইত-লাহিয়েত অঞ্চলে হামলা করেছে। এতে বেশকিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গাড়িবহরকে রাতের আধারে জেনিন ত্যাগ করতে দেখেন। এখান থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযানের সমাপ্তি ঘটেছে।
সোমবার শুরু হওয়া এই অভিযানে অন্তত ১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন ছিলেন যোদ্ধা। একজন ইসরায়েলি সেনাও প্রাণ হারিয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, জঙ্গি অবকাঠামো ও অস্ত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্যে জেনিন শরণার্থী শিবিরে সোমবার এই অভিযান শুরু করা হয়। প্রাথমিকভাবে ড্রোন হামলা দিয়ে শুরু হওয়া এ অভিযানে ১০০০ সেনা অংশ নেন।
ইসরায়েলি সেনারা চলে যাওয়ার পর শিবির ছেড়ে যাওয়া বাসিন্দারা আবার ফিরতে শুরু করেন। কেউ কেউ মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
জেনিনের ঘনবসতিপূর্ণ এই শরণার্থী শিবিরে আধা বর্গকিলোমিটারেরও কম জায়গায় প্রায় ১৪০০০ মানুষ বসবাস করেন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম তীরে যে সংঘাত চলছে, তার মধ্যে জেনিনের এই শিবিরটি ছিল মূল একটি লক্ষ্য।
ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহারের কয়েক ঘণ্টা পরেই গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েলের দিকে লক্ষ্য করে পাঁচটি রকেট ছোড়েন বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী আরও জানায়, রকেটগুলো আঘাত হানার আগেই ভূপাতিত করা হয়েছে এবং তাতক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে মঙ্গলবার ইসরায়েলের তেল আবিবে ফিলিস্তিনি হামাস জঙ্গি গোষ্ঠী দ্বারা একটি গাড়ি হামলা ও ছুরিকাঘাতের ঘটনার কথা প্রকাশ পাওয়ায় আরও উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি হয়। এ ঘটনায় আটজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, তাদের টিম যে হাসপাতালে কাজ করছিল, ইসরায়েলি সেনারা সেই হাসপাতালে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। যদিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, হাসপাতালের এলাকায় গুলি চালানোর বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কিন্তু তারা একটি সমাধিক্ষেত্রে অবস্থান নেওয়া বন্দুকধারীদের উপর বিমান হামলা চালিয়েছিল, যারা জেনিন ত্যাগ করতে থাকা সৈন্যদের জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছিল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শহরের কাছে একটি চেকপয়েন্টে বলেন, "এই মুহুর্তে আমরা আমাদের মিশন শেষ করছি এবং আমি একথা বলতে পারি যে জেনিনে আমাদের এই ব্যাপক কার্যক্রম কোনো ওয়ান-টাইম অভিযান নয়।"
হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং ফাতাহ'র মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা নিয়মিত সেনা অভিযান মোকাবিলা করার জন্য শিবিরটিতে নানা প্রতিবন্ধকতা জারি রেখেছিল এবং ওয়াচিং পোস্ট তৈরি করেছিল।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা জেনিন থেকে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা বিস্ফোরক খুঁজে পেয়েছে। একটি মসজিদের নিচে অবস্থিত সুড়ঙ্গেও এরকম বিস্ফোরকের সংগ্রহ খুঁজে পেয়েছেন তারা। এছাড়াও, সেনাবাহিনী অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে ও ৩০ সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, তারা শিবির থেকে ৫০০ পরিবারের প্রায় ৩ হাজার সদস্যকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১০০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ইসলামিক জিহাদ নিহত ১২ জনের মধ্যে চারজনকে তাদের যোদ্ধা বলে দাবি করেছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের কাছে থাকা তথ্যমতে, কোনো বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়নি।
জেনিনে সাম্প্রতিক এই সংঘাত আরও একবার প্রমাণ করেছে যে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাজনৈতিক সংঘাতের এখনও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক মহল এই অভিযান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের নিজেদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তারা সংঘাতের মাত্রা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা সামরিক অভিযানের মাত্রা দেখে তাদের আশঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে যে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনুরোধ মেনে এ বিষয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবে। সৌদি আরব ও বাহরাইন এই অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে।
এই অভিযানের প্রতিবাদে পশ্চিম তীরের একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মঙ্গলবার ধর্মঘট পালন করেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এটিকে 'যুদ্ধাপরাধ' বলে অভিহিত করেছে।