চীনে আকস্মিক সফরে কিসিঞ্জার: শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ, উষ্ণ অভ্যর্থনা
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র-চীনের আঁতাত গড়তে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। শতবর্ষে পা রাখা সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক আকস্মিক সফরেই হাজির হয়েছেন বেইজিংয়ে। মঙ্গলবার হেনরি কিসিঞ্জার দেখা করেছেন, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং শীর্ষ পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের সাথে।
বর্ষীয়ান কিসিঞ্জার বিশ্বব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত এক ব্যক্তিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে দিনকে দিন, তারমধ্যেই তার এ সফর। চীনের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরির ধারণা কিসিঞ্জারের মস্তিস্কপ্রসূতই ছিল। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসনকে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহিত করেছিলেন। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বেইজিং সফরে যাওয়া মার্কিন কর্মকর্তাদের চেয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনাই পেয়েছেন কিসিঞ্জার এই সফরে।
চীনের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক – সমাজতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই'র বিবৃতিতে তারই স্বীকৃতি প্রকাশ পায়।
ওয়াং বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্র-চীন উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলাতে ডক্টর (কিসিঞ্জার) ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। উভয় দেশের মধ্যে বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে তার ভূমিকা অপূরণীয়।"
আজ বুধবার বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে চীনের পররাষ্ট্র দপ্তর। এখানে 'ডক্টর' সম্বোধনের কারণ হাভার্ড থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রীধারী হলেন কিসিঞ্জার।
ওয়াং আরও বলেন, "চীনের প্রতি আমেরিকার নীতি কিসিঞ্জারের মতোন কূটনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং নিক্সনের মতো রাজনৈতিকভাবে সাহসীকতার হওয়া উচিত।"
মঙ্গলবার চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফুর সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে চীনে তার যে সমাদর, তারই আরেক প্রমাণ মেলে। অথচ গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠেয় এক ফোরামে শাংফুর সাথে বৈঠকে বসতে চাইলেও – তা নাকচ করে দেয় বেইজিং।
এই প্রেক্ষাপটে শাংফু- কিসিঞ্জারের বৈঠক হয়। বৈঠকের খানিকটা বিবরণ দিয়েছে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বৈঠককালে কিসিঞ্জার শাইফুকে বলেন, "চীনের বন্ধু হিসেবে তিনি দেশটিতে সফর করছেন।" উভয় দেশের উচিত "ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে সংঘাত এড়িয়ে চলা।"
ওয়াং ই'র সাথে বৈঠকেও আপোষের বার্তা দেন তিনি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কিসিঞ্জার ওয়াং ই'কে বলেন, "উভয়পক্ষের একে-অন্যকে সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত। … এক পক্ষের অন্য পক্ষকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য।"
বৈঠকগুলোর বিষয়ে এপর্যন্ত শুধু চীনা কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত বিবরণই জানা গেছে। কিসিঞ্জার এখনো এবিষয়ে তার নিজস্ব বর্ণনা প্রকাশ করেননি।
এদিকে কিসিঞ্জারের সফরের সময়েই – বেইজিংয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জলবায়ু দূত জন কেরি চীনা কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। বিগত কিছু দিনের মধ্যেই বেইজিং সফর করে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং অর্থমন্ত্রী জেনেল এল. ইয়েলেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার মঙ্গলবার এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, কিসিঞ্জার চীনে যাবেন সে সম্পর্কে অবহিত ছিল বাইডেন প্রশাসন। ব্লিঙ্কেনের সফরকালেই কিসিঞ্জারের সফর পরিকল্পনার বিষয়ে তাদের জানান চীনা কর্মকর্তারা। তবে মিলারের দাবি, "কিসিঞ্জার নিজ গরজেই এই সফর করেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে দূতিয়ালি নয়।"
অবশ্য মিলার এও জানান যে, অতীতে চীনা কর্মকর্তাদের সাথে সংলাপের বিষয়বস্তু মার্কিন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন কিসিঞ্জার। এবারের সফর শেষেও হয়তো সে ধরনের কথাবার্তা হবে তাদের মধ্যে।
বেইজিংয়ে অবস্থানের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-সহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে কিসিঞ্জার সাক্ষাৎ করবেন কিনা – সে বিষয়ে এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। এর আগে ২০১৯ সালে বেইজিংয়ে শি জিনপিং ও হেনরি কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেসময় শি তাকে বলেছিলেন, "আশা করি আরও অনেক বছর আপনার সুস্বাস্থ্য থাকবে এবং আপনি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষে অবদান রেখে যেতে পারবেন।"
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন বিভাগের ডিন উ শিনবো বলেন, পুরোনো বন্ধুত্বকে চীন কতোটা গুরুত্ব দেয় তারই প্রকাশ ঘটেছে কিসিঞ্জারকে উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে। এখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রশাসনগুলো চীনের বিরুদ্ধে যেমন আগ্রাসী নীতি নিচ্ছে – কিসিঞ্জার তার বিপরীত ব্যবস্থার পক্ষেই ছিলেন।
তার মতে, "এক্ষেত্রে প্রতীকী বার্তা দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।… আমি মনে করি, কিসিঞ্জারের চীন সফরের উদ্দেশ্যও তাই – এই বার্তা পাঠানো যে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। কারণ, শুধু স্বল্প-মেয়াদি রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণই ধ্যানজ্ঞান হতে পারে না।"
অধ্যাপক উ'র মতে, যুক্তরাষ্ট্র যতদিন চীনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে না নেয়, ততদিন উভয় দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক বাহিনী পর্যায়ে যোগাযোগে রাজি হবে না বেইজিং। এর আগে বেইজিং সফরকালে যোগাযোগের এই চ্যানেল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন ব্লিঙ্কেন, যা চীন এককথায় নাকচ করে দেয়। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎ-ও এই বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ।