মরক্কোয় ভূমিকম্প: এই গ্রামের অর্ধেক বাসিন্দা মৃত অথবা নিখোঁজ
গত ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ ভূমিকম্পের আঘাতে বিপর্যস্ত মরক্কো। গত শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাতে ৬.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যেই দুই হাজার ছাড়িয়েছে; সেইসঙ্গে আহত এবং নিখোঁজ রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এটলাস পর্বতমালার তাফেঘাঘতে গ্রামে ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গে গ্রামের জীবিত বাসিন্দাদের ভাষ্য, "এ গ্রামের মানুষ হয় মৃত, নাহয় হাসপাতালে"। ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এ গ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদক।
ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে আমরাও বুঝতে পারলাম, এখান থেকে কারোই অক্ষত বের হওয়া সম্ভব ছিল না। ইট-পাথরে নির্মিত তাদের পুরনো ধাচের বাড়িগুলো কোনোভাবেই এই মাত্রার ভূমিকম্পের ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো ছিল না।
তাফেঘাঘতে গ্রামের ২০০ বাসিন্দার মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং আরও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
"তারা ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায়নি, নিজেদের বাঁচানোর সুযোগও তাদের ছিল না", বলেন হাসান।
হাসান জানান, তার চাচা এখনও ইট-পাথরের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছেন, তাকে যে উদ্ধার করা যাবে সেই সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কারণ এখানে কারো কাছেই সে ধরনের যন্ত্রপাতি নেই এবং বাইরে থেকেও কোনো বিশেষজ্ঞ দল এসে পৌঁছায়নি।
"আল্লাহর ইচ্ছায়ই এটা হয়েছে এবং আমরা সবকিছুর জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এখন আমাদের সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। তারা সাহায্য করার জন্য আসতে খুবই দেরি করছে", বলেন হাসান।
হাসান আরও জানান, মরক্কান কর্তৃপক্ষের উচিত সব ধরনের বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ করা, কিন্তু নিজেদের অহম বা গর্ববোধ থেকে সরকার এমনটা নাও করতে পারে বলে আশঙ্কা তার।
অন্যদিকে, তাফেঘাঘতের এই ছোট্ট জনসম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা গেল, বিশেষ করে একজন ব্যক্তিকে সবাই স্বান্তনা দিচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে জানলাম তার নাম আবদু রহমান। তিনি তার স্ত্রী এবং তিন ছেলেকে হারিয়েছেন।
যেখানে বাড়ি ছিল সেদিকে আঙুল তুলে আবদু রহমান বললেন, "আমাদের বাড়ি ছিল ওখানে", কিন্তু এখন জায়গাটা শুধুই এক ধ্বংসস্তূপ।
"দেখুন ওখানে সাদা কম্বল আর আসবাবপত্রও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখন সবই শেষ হয়ে গেছে", বললেন রহমান।
আবদু রহমান জানান, যেই পেট্রোল স্টেশনে কাজ করতেন, ভূমিকম্পের পর সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দৌড়ে নিজের বাড়িতে আসেন তিনি। এরপর ছেলেমেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
"আমরা গতকাল তাদেরকে কবর দিয়েছি", বললেন শোকাতুর এই ব্যক্তি।
"আমরা যখন তাদেরকে খুঁজে পাই, সবাই একসঙ্গে জড়াজড়ি করে ছিল। আমার তিন ছেলে ঘুমিয়ে ছিল, ভূমিকম্পের পর সবাই চাপা পড়ে", যোগ করেন তিনি।
আরেকটু সামনে, গ্রামের সাথে লাগোয়া পাহাড়ি রাস্তার মোড়ে বড় একটা তাঁবুর নিচে বসে ছিল কয়েক ডজন পরিবার। চতুর্দিক থেকে শুধুই প্রিয়জনদের জন্য কান্নার আওয়াজ।
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যখন ১০ বছর বয়সী শিশু খলিফার লাশ উদ্ধার করে আনা হলো, তখন এই শোকের মাতম আরও বেড়ে গেল। এরই মধ্যে এক নারী অজ্ঞান হয়ে গেলেন এবং আরেকজন চেয়ারে ঢলে পড়ে কান্না করছিলেন।
এতদিন যাবত হয়তো আধুনিক বিশ্বের আড়ম্বর থেকে কিছুটা দূরে থাকতে পেরে প্রথাগত রীতিতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা সন্তুষ্টই ছিল। কিন্তু এখন তাদের বহির্বিশ্বের সাহায্য দরকার এবং দ্রুত এই সাহায্য পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া।
এটলাস পর্বতমালার আরেকটি সম্প্রদায়, যারা ছাগল চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে- তাইয়েব আইত ইঘেনবাজ জানান, ভূমিকম্পের পর তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছে যে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া নিজের বাবা-মাকে বাঁচাবেন নাকি তার ১১ বছরের ছেলেকে বাঁচাবেন। তাইয়েব জানান, সেই দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরছে।
শুক্রবার রাতে তাইয়েব তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের পাথরে নির্মিত ছোট্ট ঘরের ভেতরে অবস্থান ছিলেন।
সেই ঘরের জায়গায় তিনি নিয়ে যান বিবিসির প্রতিবেদককে; এখন আর সেটা তার ঘর নেই, পুরোটাই এক ধ্বংসস্তূপ। সেদিকে দেখিয়ে তাইয়েব বলেন, "ওখানেই ওরা আছে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে। ভূমিকম্প যখন হয় আমরা সবাই দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হতে যাই; আমার বাবা ঘুমিয়ে ছিলেন এবং আমি চিৎকার করে আমার মাকে ডাকছিলাম আসার জন্য। কিন্তু তিনি আমার বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।"
অন্যদিকে, তাইয়েব শুধু তার স্ত্রী ও মেয়েকেই দেখতে পেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ধসে পড়া ভবনের কাছে গিয়ে তিনি দেখেন, তার বাবা-মা এবং তার ছেলে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে; ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে তার ছেলের হাত দেখা যাচ্ছিল।
তিনি জানতেন যা করার দ্রুত করতে হবে। এরপর তিনি তার ছেলে আদমের কাছে যান এবং তাকে টেনে বের করেন।
কিন্তু যতক্ষণে তিনি তার বাবা-মাকে উদ্ধারে ফিরে যান, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা বিশাল একটা পাথরের স্ল্যাবের নিচে চাপা পড়েছিলেন।
অশ্রুসিক্ত নয়নে তাইয়েব বলেন, "আমাকে আমার বাবা-মা ও ছেলের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হয়েছে। আমি বাবা-মাকে উদ্ধার করতে পারিনি কারণ তাদের শরীরের অর্ধেকই দেয়ালের নিচে চাপা পড়েছিল। এটা ভীষণ বেদনাদায়ক। আমি আমার বাবা-মায়ের মৃত্যু দেখেছি।"
এমনকি নিজের পরনের জিন্সে লেগে থাকা রক্ত দেখিয়ে তিনি জানান, এটা তার বাবা-মায়ের রক্ত।
ভূমিকম্পে ধসে পড়া বাড়িতেই তার সব জামাকাপড়, তাই এই জিন্স বদলানোর সুযোগ হয়নি তার।
আগের ধসে পড়া বাড়ির কাছেই অস্থায়ী তাঁবু বানিয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে থাকছে তাইয়েবের পরিবার। তাইয়েব জানান, তার সব টাকাপয়সাই ঘরের ভেতরে এবং তার প্রায় সব ছাগলই মারা পড়েছে।
"মনে হচ্ছে নতুন জীবনে নতুন করে জন্ম নিয়েছি। বাবা-মা নেই, বাড়ি নেই, খাবার নেই, পোশাক নেই। আমার বয়স ৫০ বছর এবং এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে", বলেন তিনি।
কিভাবে সামনে এগিয়ে যাবেন তা আপাতত ভাবতে পারছেন না তাইয়েব। শুধু বাবা-মায়ের শেখানো একটা কথা মনে আছে তার; তারা বলতেন- 'সবসময় ধৈর্য ধরবে। কঠোর পরিশ্রম করবে, হাল ছেড়ে দেবে না।'
কথা বলতেই বলতেই তার ছেলে আদম দৌড়ে এলো, তার পরনে জুভেন্টাসের জার্সি, পেছনে রোনালদোর না লেখা। এসেই বাবার কোলে উঠলো সে।
বাবার দিকে তাকিয়ে সে বললো, 'আমার বাবা আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।'
আমিজমিজ শহরের দিকে কিছুদূর হাঁটতেই আরও একজন বাবা-ছেলেকে পাওয়া গেল। আবদুলমজিদ আইত জাফর বললেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি, তার স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়ে ঘরেই ছিলেন এবং তাদের ঘরের মেঝে ধসে পড়ে। তার ১২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ শুধু বেরিয়ে আসতে পেরেছে, বাকিরা চাপা পড়েছে।
আবদুলমজিদ জানান, তার পা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েছিল, কিন্তু এক প্রতিবেশি তাকে টেনে তোলেন। এরপরে দুই ঘণ্টা তিনি তার স্ত্রী ও মেয়েকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন; কিন্তু ততক্ষণে তারা মারা যায়। পরেরদিন তার আরেক মেয়ের লাশও উদ্ধার করা হয়।
৪৭ বছর বয়সী আবদুলমজিদ এখন রাস্তার পাশে ত্রিপল টানিয়ে থাকছেন। এখান থেকেই তার ঘর দেখা যায়, রান্নাঘরের ফ্রিজ এবং বাইরে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় দেখা যায়।
তিনি এই এলাকা ত্যাগ করছেন না কারণ তাকে তার বিষয়-আশয় দেখে রাখতে হবে এবং জীবনের অনেক স্মৃতি এখানে রয়ে গেছে।
শুক্রবারের আগপর্যন্তও ভূমিকম্পের কথা ভাবতে পারেননি আবদুলমজিদ। কিন্তু এখন তার বিশ্বাসই হয় না যে এত ভয়াবহ ভূমিকম্পে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।
"আমার বাড়িতে পাঁচজন মানুষ ছিল। এখন মাত্র দুজন। এখন আমি শুধু আমার ছেলেটার কথাই ভাবি", বলেন আবদুলমজিদ।