নীরবে হাঁটার সৌন্দর্য!
ভিডিওভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে বেশ জনপ্রিয়তা পাওয়া একটি ভিডিওতে ইনফ্লুয়েন্সার ম্যাডি মাইয়ো সবাইকে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তিনি সাধারণ হাঁটার কথা বলেননি, বলেছেন 'সাইলেন্ট ওয়াক' বা নীরবে হাঁটার কথা। ম্যাডির এই ভিডিও ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধমিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
এই ইনফ্লুয়েন্সার মনে করেন, ৩০ মিনিট এভাবে হাঁটার মাধ্যমে নিজের জীবন সম্পর্কে নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। এই আধঘণ্টা হাঁটার সময় কোনো পডকাস্ট বা গান শোনা যাবে না। এই সময়টা শুধুই 'মি, মাইসেলফ অ্যান্ড আই'—অর্থাৎ এ সময়টা শুধুই নিজের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
ম্যাডি জানান, আইডিয়াটা ছিল তার বয়ফ্রেন্ডের। প্রথমে তিনি তার কথা শুনতে চাননি। "আমার উদ্বেগের কারণে সম্ভবই হতো না,' ভিডিওতে বলেন ম্যাডি।
ম্যাডি আরও জানান, হাঁটা শুরু করার পর মনে হয়েছিল প্রথম দুই মিনিট মনের মধ্যে ভীষণ 'বিশৃঙ্খলা' চলছে। কিন্তু সেটাই পরবর্তীতে তাকে এমন গতি এনে দেয় যে তার শরীর ও মন উভয়ই বুঝে গিয়েছিল কী করতে হবে। এরপরেই তার মনের বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। মাথায় নানারকম আইডিয়া আসতে থাকে, কারণ 'আইডিয়াগুলো আসার মতো জায়গা করে দিচ্ছিলেন' তিনি।
সুস্থতা বিষয়ে টিকটকের সর্বশেষ ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে এই 'সাইলেন্ট ওয়াক' বা নীরবে হাঁটা। এটিকে ধ্যান এবং শরীরচর্চার সমন্বয় বলা যায়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি। টিকটকে আরও একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড হচ্ছে 'হট গার্ল ওয়াক', যেখানে চার মাইল হাঁটতে হাঁটতে জীবনের নানা বিষয়ে লক্ষ্যস্থির করা এবং ধন্যবাদ জানানো বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাইলেন্ট ওয়াকে মাল্টিটাস্কিং করার প্রয়োজন হয় না। এখানে শুধুই নিজের মনকে শান্ত রেখে হাঁটতে হবে এবং চারপাশের জগত সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।
নীরবে হাঁটা খুব প্রাচীন একটা প্রথা, যা মননশীলতার সঙ্গে যুক্ত। এটি ধ্যানের একটি রূপ যা মানুষকে কোনোকিছু বিচার না করে নিজের শারীরিক সংবেদন শক্তি, চিন্তাভাবনা এবং বর্তমান মুহূর্তের আবেগের দিকে মনোযোগ স্থির করতে সাহায্য করে।
নীরবে হাঁটা যেকোনো নতুন আবিষ্কার নয়, সেদিকে ইঙ্গিত করে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। তাদের ভাষ্যে, 'জেনারেশন জি মনে করছে যে তারাই হাঁটার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছে।'
কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের ৩৮ বছর বয়সী কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এরিয়েল লরের সমালোচকদের এমন মন্তব্য হাস্যকর মনে হয়েছে। সম্প্রতি নিজের পডকাস্ট এবং টিকটকে প্রায়ই নীরবে হাঁটার উপকারিতা নিয়ে কথা বলেছেন এরিয়েল। তিনি বলেন, '১৫-২০ বছর আগে এটা হয়তো কোনো আলোচনার বিষয়ই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এটা প্রাসঙ্গিক, কারণ আমাদের অনেকেই এখন ডিভাইসের প্রতি অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছি।'
তাই এখন প্রশ্ন হচ্ছে: 'কীভাবে আমরা এটাকে প্রতিহত করব?' বলেন এরিয়েল।
নিয়মিত হাঁটাকে শরীর ও মনের জন্য এক প্রকার ওষুধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট বাড়তি হাঁটলে তা দীর্ঘায়ু লাভে সাহায্য করতে পারে। ২০২০ সালে দ্য জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের মধ্যে কোনো পার্কে ৩০ মিনিট হাঁটলে, ওই সময়টা মানুষের নেতিবাচক চিন্তায় কাটানোর সুযোগ থাকে না। এছাড়াও, হাঁটা মানুষের সৃজনশীলতা বাড়াতে এবং ডিপ্রেশন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে।
এরিয়েল লরে সপ্তাহে চার দিন অন্তত ৪৫ মিনিট নিঃশব্দে হাঁটেন। তিনি জানান, বছরখানেক আগে এভাবে হাঁটার চর্চা শুরু করার পর থেকে এখন তার ভালো ঘুম হয়, মন আরও শান্ত থাকে এবং সারাদিন তিনি আরও চাঙা থাকেন।
তবে কিছু মানুষের কাছে নীরবে হাঁটা পীড়াদায়ক মনে হতে পারে। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক মানুষ একা একা বসে চিন্তা করার চাইতে নিজেকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে দিতেও রাজি! গবেষকরা লিখেছেন, 'বেশিরভাগ মানুষই কোনোকিছু না করার চাইতে কিছু একটা করতে ভালবাসে, সেটা নেতিবাচক চিন্তাই হোক না কেন।'
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁটা নিজের সঙ্গে সময় কাটানোকে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এরিন সি. ওয়েস্টগেট মানুষের মধ্যে একঘেয়েমির বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি তার গবেষণায় দেখেছেন, কোনো স্থানে যাওয়ার সময়, যেমন হেঁটে যাওয়া বা গণপরিবহনে চড়ে যাওয়ার সময়ই মানুষ সবচেয়ে মজার চিন্তাগুলো করে।
ডা. ওয়েস্টগেট বলেন, 'হাঁটা এমন কোনো কাজ নয় যেটা করতে গেলে খুব বেশি মনোযোগ রাখতে হয়, সে কারণেই হাটার সময় মানুষ দিবাস্বপ্ন দেখার সুযোগটা পায়।'
দিবাস্বপ্ন দেখাকে যদি আপনার কাছে বিলাসিতা মনে হয়, এর কারণ হতে পারে গত দুই দশকে মানুষের মনোযোগসীমা অর্থাৎ কোনোকিছুর ওপর একটানা মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেটিকসের অধ্যাপক গ্লোরিয়া মার্ক পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে মানুষ একটি স্ক্রিন কন্টেন্টের উপর গড়ে ৪৭ সেকেন্ড সময় দেয়, তারপরেই অন্য কন্টেন্টে চলে যায়। কিন্তু ২০০৪ সালের দিকে ড. মার্কের এক গবেষণায় উঠে এসেছিল যে, মানুষ একটি ই-মেইলের পেছনে গড়ে প্রায় আড়াই মিনিট সময় ব্যয় করে, তারপর অন্য কাজে মনোযোগ দেয়।
এভাবে ক্রমাগত একটার পর একটা কন্টেন্টের দিকে বা এক কাজ থেকে অন্য কাজে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া আমাদেরকে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলে, বলেন ড. মার্ক। কিন্তু নীরবে হাঁটা আমাদের সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে, যাতে করে আবারও আমরা মানসিক শক্তিতে ভরপুর থাকি। অন্যভাবে বলা যায়, কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে নিয়ে থাকাটা আসলে আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতেই সাহায্য করে।
শুধু হাঁটার সময়ই নয়, অন্যান্য সময়েও কিছুক্ষণের জন্য 'ডিজিটাল ব্রেক' নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ড. মার্ক। সারাক্ষণ শুধু কাজের চিন্তা নয়, বরং ওই বিরতির সময়টাতে সেই দিনের আবেগীয় লক্ষ্যের কথা চিন্তা করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনার লক্ষ্য যদি হয় নিজেকে শান্ত রাখা, তাহলে সেটা একটা স্টিকি নোটে লিখে রাখতে পারেন। তারপর যখন চিন্তা করতে বসবেন যে, ক্ষণিকের অবসর সময়টা কিভাবে কাটানো যায়, তখন আবার নিজের লক্ষ্যের কথা মনে পড়বে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন স্কুল-এর একজন অধ্যাপক এবং 'মাইন্ডফুল টেক' বইয়ের লেখক ডেভিড এম. লেভি বলেন, 'আমাদের অনেকেরই মনে হয় যে আমরা পেছনে পড়ে আছি এবং সামনে এগোনোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। এটা শেষ পর্যন্ত মনোযোগ-বিচ্ছিন্নতার এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে যে মানুষের আর সেই বোধই থাকে না।'
কিন্তু ভবিষ্যতমুখী সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মতো সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন এবং নিজেদের কর্মক্ষম করে তোলার জন্যই কিছু চাপ ঝেড়ে ফেলা প্রয়োজন, বলেন ড. লেভি।
'আমরা আমাদের ডিভাইসে যা কিছু করছি, এর বাইরেও পৃথিবীতে সৌন্দর্য ও প্রাণশক্তিময় অনেককিছু রয়েছে,' বলেন ড. লেভি।