ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের শেকড় কোথায়?
বর্তমানের শেকড় গভীর নিহিত হয়ে আছে অতীতে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বেলায় একই প্রবাদ খাটে। এ যুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে হাজারো মানুষের। ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে দিন গুজরান করছেন লাখো ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনি এ যুদ্ধের ইতিকথা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে একশ বছরের আগে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগটিতে পোঁতা হয়েছিল এ যুদ্ধের বিষবৃক্ষের শেকড়। আল জাজিরার 'হোয়াট ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন কনফ্লিক্ট? আ সিম্পল গাইড'-এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
৭ অক্টোবর শনিবার নজিরহীন অভিযান চালায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধা গোষ্ঠী হামাস। অজেয় ইসরায়েল বলে যে রূপকথা গড়ে তোলা হয়েছিল এতকাল, তিল তিল করে তার সবই খুইয়ে যায় আল কুদস তুফান নামের ফিলিস্তিনি অভিযানে। হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে উঠে গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় তেল আবিব। দুনিয়ার নজর এখন এ অঞ্চলে। রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে- তারপর কী প্রত্যক্ষ করতে হবে?
হামাস যোদ্ধাদের অভিযানে আট শতাধিক ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ইসরায়েলি একাধিক শহর-গঞ্জকে লক্ষ্য করে চালানো হয় অভিযান। জবাবে ইসরাইল গাজার ওপর নির্বিচারে বোমা হামলা শুরু করলে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। এছাড়া, গাজাকে পুরোপুরি অবরোধ করার ঘোষণাও দিয়েছে তেল আবিব। খাদ্য, জ্বালানি ওষুধ-পত্রসহ সব নিত্যপণ্যের কিছুই ঢুকতে দেওয়া হবে না। কোনো জনপদের ওপর এভাবে অবরোধ আরোপকে আন্তর্জাতিক আইন যুদ্ধাপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়।
ভবিষ্যতে আরো কী হবে – আগাম অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে যাই হোক না কেন তার বীজ লুকিয়ে আছে অতীতের ইতিহাসে। দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম, শিক্ষাবিদ, সমর বিশারদ এবং বিশ্ব নেতারা একসুরে বলেছেন, ফিলিস্তিন – ইসরায়েলি সংঘাত জটিল। সংকটপূর্ণ। তদুপরি এ সমস্যার সমাধানও প্রায় অসম্ভব।
বেলফোর ঘোষণা কী?
একশ বছরেরও আগের কথা। ২ নভেম্বর ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখেন।
ছোট্ট চিঠিটি মাত্র ৬৭ শব্দের। এর বিষয়বস্তু ফিলিস্তিনে একটি প্রবল ভূকম্পন সৃষ্টি করে। আজও সেই কম্পন অনুভূত হয়। এতে বলা হয় ফিলিস্তিনের ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এ রাষ্ট্র অর্জনে সহায়তা করতে ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই চিঠিই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
মোটকথা ইউরোপীয় এই শক্তিশালী দেশটি ইহুদিবাদী আন্দোলকারীদেরকে ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র স্থাপনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। অথচ ফিলিস্তিনে ৯০ শতাংশই ভূমিপুত্র ছিল আরব।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিপুঞ্জের দেওয়া ক্ষমতাবলে ১৯২৩ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে শাসন করে ব্রিটেন। এটি ব্রিটিশ ম্যান্ডেট নামে পরিচিত। এ সময়ে ইহুদিদেরকে দলে দলে বা গণ-অভিবাসনের সুযোগ করে দেয় ব্রিটিশ। এদের মধ্যে অনেকেই ইউরোপে উদীয়মান নাৎসিবাদ থেকে পালিয়ে আসে। তবে তার প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের মোকাবেলাও করে। নিজভূমিতে জনসংখ্যার এ রকম পরিবর্তন হতে দেখে বিপদের গন্ধ পেতে থাকে ভূমিসন্তান ফিলিস্তিনিরা। অন্যদিকে ব্রিটিশরা তাদের জমি-জমা, ঘরবাড়ি জব্দ করে তা ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে তুলে দিতে থাকে।
১৯৩০ এর দশকে কী ঘটেছিল?
ফিলিস্তিনে ক্রমেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরিণামে আরব বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ বিদ্রোহ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
১৯৩৬ এর এপ্রিল মাসে নব গঠিত আরব জাতীয় কমিটি ফিলিস্তিনে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকবাদ এবং ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদে ইহুদি পণ্য বর্জন এবং কর দেওয়া বন্ধ রাখার আহ্বানও জানায়।
এই ধর্মঘট ছয় মাস চলে। বর্বরোচিতভাবে ব্রিটিশ তা দমন করে। গণ-গ্রেপ্তার এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া ব্রিটিশ প্রবর্তিত সে ধারা এখন ইসরায়েল বজায় রেখেছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় ফিলিস্তিনি কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলন। ব্রিটিশ বাহিনীর উপস্থিতি এবং ঔপনিবেশিকবাদের বিরুদ্ধে চলে এ বিদ্রোহ।
১৯৩৯ এর দ্বিতীয়ার্ধে ফিলিস্তিনে ৩০ হাজার সেনা জড়ো করে ব্রিটেন।
ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোর ওপর আকাশ থেকে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ চলে। জারি করা হয় সান্ধ্য আইন, ঘরবাড়ি ধ্বংস করার কাজ চলতে থাকে। চলতে পাকড়াও করা এবং আটক রাখার ঘটনা। পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত বিচার করে প্রাণদণ্ড দেওয়া এবং তা কার্যকর করা হতে থাকে ব্যাপকভাবে।
একইসাথে ব্রিটিশ বাহিনী বহিরাগত বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের সাথে সহযোগিতা করতে থাকে। ইহুদিদেরকে নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করে। ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন কথিত সন্ত্রাস বিরোধী গোষ্ঠীর নাম দেওয়া হয় স্পেশাল নাইট স্কোয়াড।
বসতি স্থাপনকারী ইহুদি গোষ্ঠী ইশউভ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই গোপনে অস্ত্র-শস্ত্র পাচার করে আনতে শুরু করে। অস্ত্র তৈরির কারখানাও গোপনে স্থাপন করে। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী হাগানাহ প্রবৃদ্ধির জন্য এসব করা হতে পারে। এই হাগানাহ পরে ইহুদি সেনাবাহিনীর কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
তিন বছরের এ ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে অন্তত ৫ হাজার ফিলিস্তিন নিহত, ১৫ থেকে ২০ হাজার আহত এবং ৫৬০০ কারারুদ্ধ হয়।
ফিলিস্তিন ভাগের জাতিসংঘের পরিকল্পনা কী ছিল?
১৯৪৭ এ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠে। তারা গোটা জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশতে পরিণত হয়। অথচ তখন তারা দেশটির মাত্র ৬ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক ছিল।
জাতিসংঘ ১৮১ ইশতেহার গ্রহণ করে এবং ফিলিস্তিনকে আরব এবং ইহুদি অংশ ভাগ করার আহ্বান জানায়।
ফিলিস্তিনিরা এ ইশতেহার প্রত্যাখ্যান করে। কারণ? হ্যাঁ এ প্রস্তাবের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের উপকূলীয় সবচেয়ে উর্বর জমিসহ ৫৬ শতাংশ ইহুদি রাষ্ট্রকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সেসময় ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৯৪ শতাংশ ছিল ফিলিস্তিনিদের অধিকারে এবং জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ ছিল এই ভূমিসন্তানরা।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নাকাবা বা জাতিগত ফিলিস্তিনিদের নির্মূলকরণ
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ শেষ হওয়ার অর্থাৎ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে-র আগে থেকেই ইহুদিবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সামরিক অভিযান চালাতো। এসব অভিযানের মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিন শহর এবং গ্রাম-গঞ্জকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা এবং ভবিষ্যতে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রর সীমানা বাড়ানোর অপকর্ম সারতো।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে শতাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে অভিযানের ধরণ কী হবে তা ঠিক করে ফেলা হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিন শহর-গঞ্জ, গ্রাম এবং নগরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এই ধ্বংস তৎপরতাকে ফিলিস্তিনিরা 'নাকাবা' বলে। আরবিতে নাকাবার অর্থ মহাধ্বংস।
ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৭৮ শতাংশ দখল করে নেয় ইহুদিবাদী আন্দোলন। বাকি ২২ শতাংশই হলো আজকের অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা।
অন্তত সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর-জবরদস্তি করে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়।
ঘরবাড়ি এবং নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত এসব ফিলিস্তিনিদের ৬০ লাখ উত্তর পুরুষ এখন লেবানন, সিরিয়া, জর্দান এবং মিশরের নোংরা শরণার্থী শিবিরে জীবন কাটাচ্ছে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়।
তারপর দিনই প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। মিশর, লেবানন, জর্দান এবং সিরিয়ার সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এ লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ১৯৪ ইশতেহার পাস করা হয়। এই ইশতেহারে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
নাকাবার পরের বছরগুলো
অন্তত দেড় লাখ ফিলিস্তিনি নব্য সৃষ্ট ইসরায়েলি রাষ্ট্রে রয়ে গেল। তাদেরকে প্রায় ২০টি বছর কঠোর সামরিক দখলদারিত্বের মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়। পরে তাদের ধীরে ধীরে ইসরায়েলের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
মিশর গাজা উপত্যকাকে নিয়ে নেয়। ১৯৫০ এ পশ্চিম তীরের ওপর প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু করে জর্দান।
১৯৬৪ এ ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও গঠন করা হয়। এক বছর পরে রাজনৈতিক দল ফাতাহ প্রতিষ্ঠিত হয়।
নাকসা বা ছয় দিনের যুদ্ধ এবং বসতি
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের বাদবাকি অংশ দখল করে নেয় ইসরায়েল। আরব জোটের সেনাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ যুদ্ধে গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়াৎ গোলান উপত্যকা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম সবই দখল করে তারা।
কোনো কোনো ফিলিস্তিনি মনে করেন, এরই ফলে দ্বিতীয় দফা ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করা হয়। একে নাকসা বলা হয়। আরবিতে শব্দটির অর্থ বিপর্যয়।
১৯৬৭ এর ডিসেম্বরে মার্ক্সবাদী-লেলিনবাদী পুপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ফিলিস্তিন গঠন করা হয়। পরবর্তী এক দশক ধরে পরিচালিত ধারাবাহিক হামলা ও বিমান ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে বাম গোষ্ঠীটি ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি বিশ্বের নজর টানতে সক্ষম হয়।
বসতি স্থাপনের নির্মাণ তৎপরতার সূচনা হয় পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায়। দুই স্তরের ব্যবস্থা তৈরি করে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা। ইসরায়েলি সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বসতি স্থাপনকারীদের দেওয়া হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদেরকে কোনো নাগরিক বা রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়নি। কঠোর সামরিক দখলদারিত্বের জন্য তাদের জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়।
প্রথম ইনতিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩
ফিলিস্তিনি প্রথম ইনতিফাদা বা গণ জাগরণের সূচনা হয় গাজা উপত্যকায়। ১৯৮৭ এর ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি শ্রমিকবাহী দুটো ভ্যানের সাথে ইসরায়েলি ট্রাকের সংঘর্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই গণ জাগরণের সূচনা হয়।
দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম তীরে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং ট্যাংকবহর ফিলিস্তিন তরুণদের ছোঁড়া ইট-পাটকেল-পাথরের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে।
এ সময়ই দখলদার ইসরায়েলিদের সাথে প্রতিরোধে লিপ্ত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা ইসলামী ব্রাদারহুডের দলছুটদের সমন্বয়ে গঠিত হয় হামাস আন্দোলন।
কঠোর হাতে ইনতিফাদা দমন করতে নামে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। দমন-ভয়াবহতা ফুটে ওঠে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইজহাক রবিনের ফিলিস্তিনিদের 'হাড় গুড়িয়ে' দেওয়া নীতিতে।
ইনতিফাদার অগ্রদূত ছিল ফিলিস্তিনি তরুণরা। ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গঠিত ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিডারশিপ অফ দ্য আপরাইজিং নেতৃত্ব দিয়েছে। লক্ষ্য ছিল, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন স্থাপন।
১৯৮৮ এ এসে পিএলওকে আরব লিগ ফিলিস্তিনি মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ইনতিফাদাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে গণ সমাবেশ, গণ প্রতিবাদ, আইন অমান্য আন্দোলন, সুসংহত ধর্মঘট এবং সাম্প্রদায়িক সহযোগিতা।
ইসরায়েল মানবাধিকার সংস্থা বি'টসেলিমের দেওয়া তথ্যে স্বীকার করা হয়, ইনতিফাদার সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে ২৩৭ শিশুসহ ১০৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
ইনতিফাদার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সংঘাতের সমাধানে নড়েচড়ে ওঠে।
অসলোর বছরগুলো এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে অসলো চুক্তি সই এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) গঠনের মধ্য দিয়ে ইনতিফাদার সমাপ্তি ঘটে। অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা শাসনের অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে তৈরি করা হয় পিএকে এবং সীমিত স্বশাসনও মঞ্জুর করা হয়।
দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের আওতায় ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় পিএলও। পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এবং ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমি এবং পানি সম্পদ ইসরায়েলকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের অধিকার এর মাধ্যমে দেওয়া হয়।
কথা ছিল পিএ প্রথম ফিলিস্তিনি সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে এবং পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকাকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এ সরকার এবং এর রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেমে। তবে এমনটি আজও ঘটেনি।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে গাজা উপত্যকাকে ঘিরে ইসরায়েল নির্মাণ করে ইলেক্ট্রনিক এবং কংক্রিটের দেয়াল। এতে বিভক্ত দুই ফিলিস্তিনি অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় ইনতিফাদা
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ইনতিফাদার সূচনা হয়। লিকুদ বিরোধী দলীয় নেতা অ্যারিয়েল শেরন পবিত্র আল আকসা চত্বরে উসকানি মূলক পরিদর্শন করেন। জেরুজালেমের পুরানো নগরীর ভেতর এবং বাইরে একে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী এবং ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘাতে দুইদিনে ৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়।
এই ঘটনায় ব্যাপক সশস্ত্র অভিযান চলে। ইনতিফাদা চলাকালে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোর নজিরহীন ক্ষতি করে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শাসিত অঞ্চলগুলো আবার দখল করে নেয় ইসরায়েল। সেখানে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে। সে অঞ্চলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের এ জন্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় এবং দিতে হয় চড়া মূল্য।
দখলকৃত অঞ্চলে বসতি নির্মাণকে আন্তর্জাতিক আইনে পরিষ্কারভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ভূমি অপহরণ করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের তৎপরতা অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করার তোড়ে ফিলিস্তিনিদের অঞ্চল ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। দখলকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে কেবল বসতি স্থাপনকারীদের জন্য রাস্তা এবং অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। এতে ফিলিস্তিন নগর এবং শহরগুলো ছিটমহলের মতো হয়ে যায়। বর্ণবাদী শাসকের আমলে কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের আবাসিক অঞ্চলগুলোর যে অবস্থা হয়েছিল তাই হয়।
অসলো চুক্তি সইয়ের সময়ে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে এক লাখ ১০ হাজারের বেশি ইহুদি বসতি স্থাপনকারী বসবাস করত। কিন্তু আজকের দিতে এ সংখ্যা বেড়ে সাত লাখে দাঁড়িয়েছে। এক লাখ হেক্টর বা ৩৯০ বর্গমাইল ভূমি ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জবরদস্তির সাথে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বিভক্তি এবং গাজা অবরোধ
২০০৪ এ মারা যান ইয়াসির আরাফাত। এক বছর পর দ্বিতীয় ইনতিফাদার অবসান ঘটে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বসতি সরিয়ে নেওয়া হয়। নয় হাজার ইসরায়েলি সেনাসহ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসে।
এক বছর পর ফিলিস্তিনিরা প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ভোট দেয়।
হামাস বেশিরভাগ আসনে বিজয়ী হয়। এরপর ফাতাহ-হামাস গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কয়েকমাসের গৃহযুদ্ধে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
গাজা উপত্যকা থেকে ফাতাহকে বের করে দেয় হামাস এবং পিএর প্রধান দল ফাতাহ পশ্চিম তীরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে হামাসের বিরুদ্ধে কথিত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে গাজা উপত্যকার ওপর অবরোধ চাপিয়ে দেয় ইসরায়েল।
গাজা উপত্যকার ইসরায়েল, ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ এ চার দফা সামরিক হামলা চালায়। নির্বিচার হামলায় নারী শিশুসহ অনেক নিহত হয়। হাজার হাজার ঘরবাড়ি, বিদ্যালয় এবং দপ্তর ভবন গুড়িয়ে দেয় ইসরায়েল।
২০০৮ এর যুদ্ধে ইসরায়েল ফসফরাস গ্যাসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করে।
২০১৪ তে ৫০দিনে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৫০০ শিশু, ১৪৬২ বেসামরিক মানুষসহ ২১০০ বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ নামে পরিচিত ইসরায়েলের এ আগ্রাসনে অন্তত ১১ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়। ধ্বংস করা হয় ২০ হাজার ঘরবাড়ি। আর বাস্তুহারা হয় অন্তত ৫ লাখ মানুষ।