গাজায় স্থল অভিযান নিয়ে ইসরায়েলকে সতর্ক করল ইরান
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে তেল আবিব এমন কিছু করলে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে বলে ইসরাইলকে সতর্ক করেছে ইরান।
গতকাল (রবিবার) আল জাজিরার কাছে সাক্ষাৎকার প্রদানের সময় এমন মন্তব্য করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদুল্লাহিয়ান। একইসাথে গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ চলতে থাকলে লেবানন সীমান্তে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার 'সব ধরনের সম্ভাবনা' রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আমিরাবদুল্লাহিয়ান বলেন, "গাজা উপত্যকায় শিশুদের হত্যা থেকে শুরু করে সর্বোপরি ইসরায়েলি হামলা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানাই। অন্যথায় যুদ্ধের আরও অনেক নতুন ফ্রন্ট খুলতে পারে। এই সম্ভবনা যেন ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
আমিরাবদুল্লাহিয়ান ইসরায়েলের গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, "ইসরায়েল গাজায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলে সেখানে থাকা প্রতিরোধকামী নেতারা অঞ্চলটিকে দখলদার সেনাদের কবরস্থানে পরিণত করবে।"
হামাসের হামলার পর থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ক্রমাগত বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। এতে এখন পর্যন্ত ২,৬৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে; যাদের এক-চতুর্থাংশই শিশু। আহত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার গাজাবাসী। অঞ্চলটিতে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়।
এদিকে গত শুক্রবার গাজা শহরের ১০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে বলে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। এতে করে বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এরপর গত শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০ টা থেকে বেলা ৪ টা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে দুটি রাস্তা ব্যবহার করে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার ফের নির্দেশনা দেয় আইডিএফ।
আইডিএফের নির্দেশকৃত রাস্তাগুলো ব্যবহার করে যাতায়াত করলে বেসামরিক নাগরিকদের কোন ধরনের ক্ষতি হবে না বলেও আশ্বস্ত করেছিল মুখপাত্র আদরাই।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার সময় বিমান হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। জাতিসংঘের অনুমান মতে, গাজার প্রায় ১০ লাখ গাজাবাসীর বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে হামাসের হামলায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৮৯ জন সেনা ও বিদেশি নাগরিকও রয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামাসের এ হামলার পেছনে ইরানের জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। তবে তেহরান এমন অভিযোগ বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছে।
গত শনিবার কাতারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাবদুল্লাহিয়ান ও হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ সাক্ষাৎ করেছেন। হামাসের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে জানানো হয়, বৈঠকে গাজা সংকট নিয়ে আলোচনা শেষে উভয় পক্ষই সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।
অন্যদিকে গত শনিবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খমেনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসা সমস্ত মুসলিম দেশের কর্তব্য। একইসাথে গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে কূটনৈতিক চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে তেহরান।
তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি আমিরাবদুল্লাহিয়ান ইরাক, লেবানন ও সিরিয়া সফর করেছেন। ইসরায়েল আলেপ্পো এবং দামেস্ক বিমানবন্দরে হামলার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাথে সাক্ষাতও করেছেন তিনি।
একইসাথে গতকাল (রবিবার) আমিরাবদুল্লাহিয়ান কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথেও দোহায় সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে আলাপকালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "গাজার নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর হামলা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যেতে পারে এবং যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত হবে পারে।"
সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এএফপিকে বলেছে, ইসরায়েলের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব। এই বিষয়ে ইতিমধ্যে মার্কিন কর্মকর্তাদের অবগত করেছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব কখনোই ইসরায়লকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে সম্পাদিত তথাকথিত আব্রাহাম চুক্তিতেও অংশ নেয়নি সৌদি আরব।
অন্যদিকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গত বৃহস্পতিবার ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সাথে টেলিফোনে কথা বলেছে। দুই নেতার আলোচনায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কথা বেশ গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে।
আর যুদ্ধ একাধিক ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এই অঞ্চলে ইরানের গতিবিধি কমাতেই সিরিয়ার বিমানবন্দরে হামলা করেছে বলে জানিয়েছে তেল আবিব।
অন্যদিকে হিজবুল্লাহর সাথে ইসরায়েলি বাহিনী সংঘর্ষ চলছেই। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় লেবাননের সাথে সীমান্তকে 'বন্ধ সামরিক অঞ্চল' বলে ঘোষণা করেছে দেশটি।
গত শনিবার প্রকাশিত মার্কিন গণমাধ্যম এক্সিওস এর রিপোর্ট মতে, "ইরান জাতিসংঘের মাধ্যমে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে যে, তারা গাজায় চলমান সহিংসতা চায় না। এক্ষেত্রে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকলে তেহরানের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হবে।"
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মার্কিন শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেও সতর্ক করা হয়েছে। একইসাথে গাজা সীমান্তে লড়াইয়ের পাশাপাশি নেতানিয়াহু সরকারকে উত্তরে লেবানন সীমান্তে সৃষ্ট ঝুঁকির কথাও ভাবতে হচ্ছে।
কারণ লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যদি লড়াইয়ে নতুন ফ্রন্ট সৃষ্টি হয়, তাহলে তা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলবে। মধ্যপ্রাচ্যে বাড়বে সংঘাতের পরিসরও।
এমতাবস্থায় ইসরায়েলের সমর্থনে বিমানবাহী দ্বিতীয় রণতরি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন গতকাল (রবিবার) এই তথ্য জানিয়েছেন।
অস্টিন বলেন, "ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকানো বা হামাসের হামলার পর এই যুদ্ধকে আরও প্রসারিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা রুখতে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিমানবাহী দ্বিতীয় রণতরি বহর পাঠাচ্ছে।"
ইউএসএস আইজেনহাওয়ার এবং এর অধিভুক্ত যুদ্ধজাহাজের বহর এক সপ্তাহে আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো আরেক রণতরির সঙ্গে যোগ দেবে। অস্টিন বলেন, "এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের নিরাপত্তার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের দৃঢ় অঙ্গীকারের ইঙ্গিত বহন করে।"
অন্যদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ বাড়লে তাতে ইরান সরাসরি জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সিবিএস নিউজে কথা বলার সময় হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান লেবাননের সাথে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে একটি নতুন ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ইরানের কথা বলেন।
সুলিভান বলেন, "আমরা ইরানের সরাসরি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। আমাদের সম্ভাব্য সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।"