‘বন্ধু থেকে শত্রু’: যুদ্ধের জেরে চাকরি খোয়াচ্ছেন ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিরা
৭ অক্টোবর শনিবার আর সবদিনের মতো ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে কাজ করতে যান নৌরা (ছদ্মনাম)। ওই হাসপাতালে তিনি গত দুবছর চাকরি করছিলেন।
শনিবারের হামলার খবর একটু দেখেই কাজে ছুটে যান নৌরা। তখনো ঘটনার গভীরতা তিনি অতটা আঁচ করতে পারেননি। ইসরায়েলে সেদিন ফিলিস্তিনি সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস আচমকা আক্রমণ করে। ওই হামলায় কমপক্ষে ১,৩০০ মানুষ নিহত হন।
প্রত্যুত্তরে ইসরায়েল গাজায় বোমাহামলা শুরু করলে ২,৩০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন। ইসরায়েল বর্তমানে গাজা অবরোধ করে রেখেছে, শীঘ্রই সেখানে স্থল আক্রমণ শুরু করতে পারে দেশটি।
সেদিন সকালে যখন আরেক সহকর্মী কাঁপতে কাঁপতে এসে নৌরাকে বলেছিলেন কী হচ্ছে, নৌরা তখন তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, 'এ তো আর প্রথমবার নয়' — নৌরা এখন বুঝতে পারেন তার ওই উত্তরে সমানুভূতির অভাব ছিল।
কিন্তু ঘটনা যত গড়াল, হামাসের আক্রমণের নজিরবিহীন মাত্রা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল, নৌরার ডাক পড়ল তার ম্যানেজারের ঘরে। তাকে বলা হলো কাজ ছেড়ে চলে যেতে এবং পরবর্তী নোটিশ না দেওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে কাজে না ফিরতে। এ সিদ্ধান্তের কারণ, সহকর্মীর সঙ্গে তার আগের সেই কথোপকথন।
'আমার খুব অপমানবোধ হলো, বিশ্বাসই হচ্ছিল না এমনটা ঘটছে আমার সঙ্গে,' বলেন নৌরা। নৌরা সেই ১২ লাখ ফিলিস্তিনিদের একজন, যারা ইসরায়েলের নাগরিক। এ ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।
'আমার মনে হলো আমি বৈষম্যের শিকার। আমি হুট করে বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে গেলাম,' নৌরা বলেন।
এ ঘটনার পর দ্রুতই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা থেকে একটি চিঠি পান নৌরা। সেখানে বলা হয়, নৌরা হামাসের আক্রমণ সমর্থন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে যা প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলাভঙ্গেন নীতিবিরোধী কাজ। তাই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি ছাড়তে হবে।
যেসব কথা বলার জন্য নৌরাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার একটিও উচ্চারণ করেননি বলে দাবি করেন তিনি। নৌরা জানান, তার পদত্যাগ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক শুনানি হয়েছিল। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কথা শোনেনি, তারা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কেবল নৌরা একা নন। ইসরায়েলের আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কয়েক ডজন অভিযোগ পেয়েছে। গত শনিবার থেকে তাদেরকে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মস্থল থেকে হঠাৎ করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের পোস্ট এবং কিছুক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে তাদের কথোপকথনের দরুন তারা সাময়িক বরখাস্তের শিকার হয়েছেন।
আল জাজিরার কাছে আসা এরকম কয়েকটি চিঠিতে এসব ব্যক্তিদেরকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'সন্ত্রাসবাদ' সমর্থনের অভিযোগে 'তদন্তের আগ পর্যন্ত' তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে শৃঙ্খলা কমিটির সামনেও উপস্থিত হতে হয়।
দ্য লিগ্যাল সেন্টার ফর আরব মাইনোরিটি রাইটস ইন ইসরায়েল – আদালাহ-এর পরিচালক হাসান জাবারিন বলেন, 'যারা তিন, চার, পাঁচ বছর কাজ করছেন, তাদেরকে চিঠি পাঠিয়ে তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য কাজে না আসতে বলা হয়েছে।'
'কিছু চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব নিয়ে পরে কোনো এক সময় শুনানি হবে, কিন্তু সেগুলোতে তারিখ স্পষ্ট করে দেওয়া হয়নি। কারও বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই শুনানি হওয়া উচিত,' হাসান আরও বলেন।
আদালাহ এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন কর্মীর সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার কথা জানতে পেরেছে। এদের বেশিরভাগ বরখাস্ত হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের কারণে। এছাড়া ইসরায়েলি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে বহিষ্কার বা বরখাস্তের নোটিশ পাওয়া ৪০ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও অভিযোগ পেয়েছে এটি।
নাজারেথের আরব ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন-এর পরিচালক ওয়াবি বাদারানি আল জাজিরাকে জানান, ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত ৩৫টি এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন হাসাপাতাল, হোটেল, গ্যাস স্টেশন, রেস্তোরাঁ ও কল সেন্টারের কর্মীরা রয়েছেন।
'সহিংসতায় উসকানি দেওয়া একটি গুরুতর অভিযোগ যেটা আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। আমাদের মতে, এখন যা ঘটছে তা বৈধ নয়,' বলেন আদালাহ-এর একজন আইনজীবী সালাম ইরশেইদ।
তেল আবিবের এক ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী আল জাজিরাকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। এখানে আমিই একমাত্র ফিলিস্তিনি কর্মী। প্রতিদিন সকালে আমাকে এখানে গম্ভীর ও রাগী সব চেহারা দেখতে হয়।'
জাফায় প্রায় তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ইসরায়েল-এর বোর্ড চেয়ারপার্সন ডা. লিনা কাসেম হাসান রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমার দৃষ্টিতে হামাস যা করেছে তা যুদ্ধাপরাধ, এবং গাজায় ইসরায়েল যা করে সেটাকেও আমি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে দেখি।'
এ সাক্ষাৎকারের ঘণ্টা দুয়েক পরে তিনি তার নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে একটি ফোনকল পান। তাকে অবশ্য গণমাধ্যমে কথা বলতে নিষেধ করা হয়নি, কিন্তু, তিনি বলেন, 'এটা যেন আমার জন্য একটা সতর্কতা ছিল, যেন আমি আরও সাবধান হয়ে যাই।'
'রেসিজম এখন বেড়ে গিয়েছে। আমরা বর্তমানে যা দেখছি, তা আগে কখনো দেখা যায়নি,' আল জাজিরাকে বলেন অ্যাটর্নি সাওসান জাহের।
মানুষ এখন প্রকাশ্যে 'আরবি বলতে আগের চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে' বলে জানান তিনি।