পাকিস্তানে ফিরলেন দেশটির সেনাবাহিনীর এক সময়ের 'শত্রু' নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে স্বেচ্ছায় নির্বাসন শেষে দেশে ফিরেছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। গতকাল (শনিবার) দুবাই থেকে ফ্লাইটে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। খবর বিবিসির।
দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য সময় নওয়াজ দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। শেষবার তিনি যখন পাকিস্তানে ছিলেন, তখন দুর্নীতির দায়ে কারাভোগ করতে হয়েছিল সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে অসুস্থতা বিবেচনায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন এয়ার এম্বুলেন্সে করে চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়েন তিনি। তারপর থেকে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে লন্ডনে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে ছিলেন তিনি।
তবে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যেই সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজের পতন ঘটিয়েছিল, ঠিক তারাই এই রাজনীতিবিদকে দেশে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। এমনকি নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রবল সম্ভবনাও তার রয়েছে।
অন্যদিকে নওয়াজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইমরান খান। কিন্তু বর্তমানে তিনিই আবার প্রধানমন্ত্রীত্ব হারিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে কারাভোগ করছেন।
তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের গত চার বছর কেটেছে লন্ডনে। তবে ২০২২ সালে সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ফের বাড়াতে থাকেন।
ইমরান প্রধানমন্ত্রীত্ব হারালে নওয়াজের দল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করা হয়। আর তার ছোট ভাই শাহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
যদিও নওয়াজের বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। কিন্তু দেশে পৌঁছানোর পর এখনই তার গ্রেফতার হওয়ার শঙ্কা নেই। কেননা আগামী সপ্তাহের শুনানি পর্যন্ত তার জামিন মঞ্জুর রয়েছে।
১৯৯৯ সালেও সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন নওয়াজ। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের সেনা শাসন কাটিয়ে ২০০৭ সালে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও সেখানে বেনজীর ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি জয়লাভ করে। কিছুদিন পরেই অবশ্য এক র্যালিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ঐ নারী প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন নওয়াজ শরীফ। তবে সেক্ষেত্রে বেশ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদকে।
কেননা একদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতি বেশ সংকটে রয়েছে। অন্যদিকে প্রধান প্রতিপক্ষ ইমরান খান জেলে থাকার কারণে ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আর পরিশেষে দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী সেনাবাহিনীর সাথেও তার সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।
লন্ডনে থাকাকালীন নওয়াজ দেশটির সেনাবাহিনীর কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে আইএসআই এর একজন সাবেক প্রধান এবং সাবেক এক সেনাপ্রধানকে দেশে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী করেছেন। যদিও এই অভিযোগগুলো তাদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
নওয়াজ দাবি করেন, তাকে মিথ্যা মামলায় ভুক্তভোগী করা হয়েছে। একইসাথে দেশটির বিচারকদের বিরুদ্ধে যোগসাজশের অভিযোগ করেছেন তিনি।
নওয়াজ মনে করেন, এসব কারণে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। একইসাথে দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রীকে তাদের সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ করতে পারেনি।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধীরা অভিযোগ করছেন যে, নওয়াজ দেশে ফেরা নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেছে। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি জয়লাভ করতে পারে পারবেন কি-না; সেই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তারা।
ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইন্সাফের নেতা জুলফি বুখারী বিবিসিকে বলেন, "আমি মনে করি না যে, নওয়াজ ফের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। কেননা তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এছাড়াও আদালত তাকে রাজনীতি থেকে আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছে।"
অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ইমরান খান জেলে যাওয়ার পর থেকে তার দলের সমর্থকেরা কিছুটা নিশ্চুপ রয়েছে। তবে দলের জয়ের ব্যাপারে এখনো আশাবাদী তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াজাহাত মাসুদ বলেন, "পাকিস্তানের রাজনীতিতে দৃশ্যপট ও চিত্রনাট্য বদলায়নি। শুধু রাজনৈতিক চরিত্র বদলাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ইমরান খানকে প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। এবার সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফের জন্য নির্বাচন করতে ব্যস্ত।"
বর্তমানে নওয়াজের প্রধান প্রতিপক্ষ ইমরান খান কারাগারে। গত মে মাসে তার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভের পর ধরপাকড়ে তার দলও সাংগঠনিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই অনেকে মনে করছে, আসন্ন নির্বাচন হয়তো সুষ্ঠু হবে না।
এ বিষয়ে জুলফি বুখারী বলেন, "জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে কারাগারে আটকে রাখা হয় কীভাবে? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেখবেন ইমরান খানের ভোটব্যাংক কতটা শক্তিশালী।"