আয় নেই, থমকে গেছে জীবন: জেরুজালেমের ওল্ড সিটির ফিলিস্তিনিদের দিনরাত্রি
যে শহর একসময় ছিল হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মধ্যে জেরুজালেমের সেই ওল্ড সিটি এখন শান্ত, নীরব।
শহরের পবিত্র স্থানগুলো ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রেতার দেখা নেই। যুদ্ধের প্রায় চার সপ্তাহ ধরেই দোকানগুলো বন্ধ।
যেসব দোকানদার সাহস করে দোকান খুলে বসেছেন তারা দিনের পর দিন পর্যটকের অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
৪৮ বছর বয়সী ট্যুর গাইড ও স্যুভেনির শপ মালিক মারওয়ান আত্তিয়েহ বলেন, এখানে পর্যটন শিল্প বলে আর কিছু নেই।
তিনি বলেন, আমাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে…এখানে কোনো ব্যবসা নেই, আয় নেই, কোনো মুনাফা নেই, জীবন থমকে আছে। আমাদের কাছে টাকা না থাকলে আমরা কীভাবে ব্যয় করব?
দেয়াল ঘেরা পূর্ব জেরাজালেমের এই ওল্ড সিটিতে একই সাথে মুসলমান (আল আকসা ও ডোম অব দ্য রক) , খ্রিষ্টান (চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার) এবং ইহুদীদের (টেম্পল মাউন্ট) পবিত্রতম স্থান অবস্থিত। অনেক মুসল্লি, তীর্থযাত্রী এবং পর্যটক প্রতিনিয়ত এখানে আসেন।
কিন্তু ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলা, এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অনবরত বোমাবর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞের পর থেকে ওল্ড সিটির পর্যটন খাতে ধস নেমেছে।
বেশিরভাগ খ্রিষ্টানের বিশ্বাস চার্চ অব দ্য হলি সেপুলচারে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং কবর দেওয়া হয়েছিল। সেই চার্চও বৃহস্পতিবার ছিল পুরো ফাঁকা। শুধু পুরোহিতদের দেখা গেছে।
জেরুজালেমে অধ্যয়নরত ৩১ বছর বয়সী ইতালীয় সেমিনারি ছাত্র পিয়েত্রো ম্যাজোকো বলেন, 'আগে এই জায়গায় প্রাণের সঞ্চার ছিল। মানুষ প্রার্থনা করত, ঈশ্বরের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা জানাত। আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ ছিল জায়গাটি।
'কিন্তু এখন জায়গাটি পুরো ফাঁকা। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন কোনো মানুষ নেই।' যোগ করেন পিয়েত্রো।
ইসরায়েলের সঙ্গে অনেক ফ্লাইট বাতিল হয়েছে, ট্যুর প্যাকেজ বাতিল করা হয়েছে। তারপরও কিছু পর্যটক অবশ্য তাদের কাঙ্খিত ওল্ড সিটিতে প্রবেশ করতে পেরেছেন।
ফ্রান্সের পর্যটক রাচিড (২৪) তার ইসরায়েল ও জেরুজালেম ভ্রমণ বাতিল না করে বরং নিচ চোখে এখানকার বাস্তবতা দেখতে চেয়েছেন।
এক সপ্তাহ আগে জর্ডানের স্থল সীমান্ত হয়ে ওল্ড সিটিতে প্রবেশ করেন তিনি। তবে তার আগে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।
তিনি বলেন, 'এটা অনেকটা অদ্ভুত, সড়কে কোনো মানুষ নেই।' এখানে আসার পর থেকে ইসরায়েলি পুলিশ তাকে থামিয়ে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলেও জানান রাচিড।
তিনি বলেন, উভয় পক্ষ (স্থানীয় ও ইসরায়েলি) আমাকে ভয় পাচ্ছে। তারা খুবই সতর্ক, তারা জানে না আমি কে, কোথা থেকে এসেছি।
পর্যটনের বাইরে নগরের স্বাভাবিক জীবনও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার আল-আকসা মসজিদে মুসল্লি সংখ্যা ছিল কম। পূর্ব জেরুজালেমে চেকপয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। জোর তল্লাশিও চলছে।
ফিলিস্তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ওল্ড সিটির বেশিরভাগ বাসিন্দা তার ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। তারা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের আশঙ্কা করছেন।
ইসরায়েলি অভিযানের মধ্যে নিকটবর্তী পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। অবৈধ বসতী স্থাপনকারী ও সামরিক বাহিনী ১৩০ জনকে হত্যা করেছে।
বুধবার গাজাবাসীর সমর্থনের অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
বৃহস্পতিবার অনেক ব্যবসায়ী নিজের নিরাপত্তার খাতিরে মুখ খোলেননি। ওল্ড সিটির দোকানদার ইমাদ সিদেয়ী বলেন, এটা বিপজ্জনক সময়, এখন কিছুই নিরাপদ নয়। সেনারা প্রতিদিন মানুষদের পেলের লাথি দিচ্ছে। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে না।
অনেকেই মনে করেন যুদ্ধ স্বল্পসময়ে শেষ হবে না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি হবে না।
সিদেয়ী বলেন, আমি প্রতিদিন শান্তি কামনা করি। আমরা পশুর মতো একে অপরকে মারতে চাই না। আমাদের বাঁচতে হবে।