লোহিত সাগরে হুথিদের কাছে কি অসহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?
লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্কিন নৌবাহিনীর নেতৃত্বে 'অপারেশন প্রসপারেটি গার্ডিয়ান (ওপিজি)' অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে। অভিযানে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ একজোট হলেও ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওপিজি'র মূল লক্ষ্য কী?
অপারেশন প্রসপারেটি গার্ডিয়ানের মূল লক্ষ্য আন্তর্জাতিক নৌপথে চলা সকল বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করা। তবে অ্যাডমিরালরা চান রাজনীতিবিদরা তাদেরকে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেবেন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের লক্ষ্যে।
সুয়েজ খালের কাছাকাছি ভ্রমণকারী জাহাজগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরক বহনকারী ড্রোন দ্বারা হামলা করা হচ্ছে। এই হামলাগুলো এসেছে ইয়েমেন থেকে, করছে হুথি গোষ্ঠী (আনসার আল্লাহ)। লোহিত সাগরের উপকূলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশসহ ইয়েমেনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এ দলটি। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। তবে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের যে ওয়ারহেড রয়েছে সেগুলে বড় পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিতে না পারলেও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে।
হুথিরা প্রথম দিকে শুধু ইসরায়েল মালিকানাধীন জাহাজে হামলা করার কথা জানালেও এখন ইসরায়েলের সাথে ব্যবসা করা কিংবা ইসরায়েল বন্দর থেকে আসা সকল জাহাজের ওপরই হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইসরায়েলি সংযোগ আছে এমন কয়েকটি জাহাজে হামলা করার পর থেকে এখন ধারণা করা হচ্ছে যেকোনো জাহাজই তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
মার্কিন এবং ফরাসি যুদ্ধজাহাজগুলো উন্নত ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য (সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল; স্যাম) ব্যবহার করে সফলভাবে সমস্ত আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করেছে। এর মাধ্যমে আধুনিক ফেইজড অ্যারে রাডারের ভার্টিক্যাল-লঞ্চ সিস্টেমের কার্যকারিতাও প্রমাণিত হয়েছে। অপারেশন প্রসপারেটি গার্ডিয়ানের অন্যান্য দেশগুলোরও একই ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ রয়েছে। এই জাহাজগুলো আধুনিক স্যাম দিয়ে সজ্জিত যা সমুদ্র এবং স্থল-ভিত্তিক উভয় লক্ষ্যকে আঘাত করতে পারে।
ওপিজি অভিযানের যদি শুধু বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে রক্ষা করাই মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে একটি সহজ পদ্ধতি হবে নৌযান চালানোর পুরোনো একটি কৌশলকে অবলম্বন করা। অর্থাৎ যুদ্ধজাহাজকে সামনে রেখে কনভয় আকারে বাকি জাহাজগুলোর পেছন পেছন চলা। ধীরগতির বাণিজ্যিক জাহাজগুলো সংগঠিত এসব বহরের সামনে, পেছনে বা পাশে যুদ্ধজাহাজ থাকে। যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পণ্যবাহী জাহাজগুলো রক্ষা করতে সফলভাবে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছে।
তবে, কনভয় কৌশলের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কনভয়গুলো বড় জাহাজগুলোকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য মাইল পর্যন্ত প্রসারিত হয়। কিন্তু তারপরও এত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েও ৩০০ মিটার (৯৮৪ ফুট) লম্বা বিশাল ট্যাংকার এবং কন্টেইনার ক্যারিয়ার বিশিষ্ট জাহাজগুলো হামলার আশঙ্কায় থেকে যায়। বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকদের কনভয়ে জাহাজ পরিচালনার প্রশিক্ষণের অভাব থাকে এবং বড় দলে বা সামরিক কমান্ডের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা কম থাকে।
যেসব যুদ্ধজাহাজ কনভয় জাহাজের নিরাপত্তা দেবে সেগুলো অস্ত্রে সজ্জিত থাকলেও সীমিত সংখ্যক মিসাইল বহন করে। তাই মিসাইলগুলো তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক মিতব্যয়িতার সহিত ব্যবহার করা লাগবে। এছাড়া যুদ্ধ পরিস্থিতি এলে নিজেদের সুরক্ষার জন্যও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। একবার তারা কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার পর, তাদেরকে আবার এগুলো পুনরায় পূরণ করতে হয়। এ কাজ সমুদ্রে করা গেলেও হুথি ক্ষেপনাস্ত্রের নাগালের বাইরে কোনো বন্দরে করা বেশি দ্রুত ও নিরাপদ।
উল্লেখ্য, বাব আল-মান্দেব প্রণালির কাছে ইয়েমেনি উপকূল বরাবর আনুমানিক ১৫ নট (২৮ কিমি/ঘন্টা) গতিতে ঝুঁকিপূর্ণ আড়াইশো নটিক্যাল মাইল (৪৬৩ কিমি) পাড়ি দিতে গেলে জাহাজগুলো অন্তত ১৬ ঘণ্টা হুথি মিসাইল ও ড্রোন হামলার লক্ষ্যবস্তুতে থাকবে। এছাড়া কনভয় যাত্রা শুরুর আগে জাহাজগুলো লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের যে এলাকায় জড়ো হয় সেখানেও হামলার উচ্চ আশঙ্কা রয়েছে।
হুথিদের নিকট পর্যাপ্ত অস্ত্রের মজুত একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। এছাড়াও তাদের শক্তিশালী-সমন্বিত আক্রমণ চালানোর সক্ষমতাও নৌ-পরিকল্পকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯ অক্টোবরে হুথিরা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কার্নিতে চারটি ক্রুজ মিসাইল এবং ১৫টি ড্রোন হামলা করে। ইউএসএস কার্নি এখনও অপারেশন প্রসপারেটি গার্ডিয়ানের অংশ হিসেবে লোহিত সাগরে সক্রিয় আছে। নয় ঘণ্টার এ আক্রমণ হুথিদের যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজাতে একটি পরীক্ষার অংশ ছিল। এই সময় ইউএসএস কার্নির সদস্যদের উচ্চ সতর্ক থাকতে হয়েছিল হুথিদের নিক্ষেপ করা সমস্ত আগত ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিজেদের রক্ষা করতে।
সামরিক কর্মকর্তারা তাদের উর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের শুধু হুথিদের ছোড়া মিসাইল ধ্বংস না করে বরং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মোবাইল লঞ্চ সাইট, অস্ত্রাগার, রাডার সাইট বা ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিতে হামলা করার পরামর্শ দেবেন।
তাত্ত্বিকভাবে, হুথিদের ক্ষেপনাস্ত্র অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করতে স্যাটেলাইট, আনম্যান্ড অ্যারিয়াল ভেহিক্যালস (ইউএভি, এক ধরনের ড্রোন) ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া, লোহিত সাগর বা ভারত মহাসাগর থেকে উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র, সেইসাথে দূরবর্তী স্থলঘাঁটি পরিচালিত সশস্ত্র ড্রোন হামলার মাধ্যমেও তাদের প্রতিহত করা যাবে। তবে সব থেকে কার্যকর পন্থা হবে, ওই অঞ্চলে থাকা দুটি মার্কিন নিউক্লিয়ার এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার থেকে বোমারু বিমান দিয়ে তাদের ওপর হামলা করা।
সরাসরি ইয়েমেনের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সামরিক ন্যায্যতা থাকলেও তা রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। হুথিরা বলেছে, লোহিত সাগরের জাহাজে তাদের হামলার উদ্দেশ্য ইসরায়েলকে তার সামরিক অভিযান বন্ধ করতে প্রভাবিত করা। সুতরাং, ইয়েমেনে যেকোনো মার্কিন হস্তক্ষেপকে ইসরায়েলের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সংঘাতের চোখে দেখা যেতে পারে।
সংঘাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতামূলক অবস্থান অবলম্বন করছে। তারা কূটনৈতিকভাবে জড়িত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সাথে মিলে তাদের মিত্র ইসরায়েলকে দ্রুত সংঘাত অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। যদিও তাদের এই অনুরোধ ইসরায়েল আমলে নেয়নি।
হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগন একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদি তারা কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে লোহিত সাগরের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা মার্কিন, ইউরোপীয় এবং এশীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবার বর্তমানে গৃহীত পদক্ষেপ হিসেবে মিসাইল সাইটে আক্রমণ না করে শুধু কনভয়কে এসকর্ট করা যথেষ্ট নাও হতে পারে। এর দ্রুত সমাধান করতে না পারলে, এটি চরম অর্থনৈতিক সমস্যার তৈরি হবে। আর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণ করা শুরু করে তাহলে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনা করে ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন সতর্ক ও নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। তারা তাদের দেশের জাহাজ রক্ষার জন্য লোহিত সাগরে তাদের নিজস্ব ফ্রিগেট (এক ধরনের যুদ্ধজাহাজ) পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। আর মার্কিন নৌবাহিনী যদি ইয়েমেনে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ইউরোপীয় দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারে এই যুক্তিতে যে তারা এই সংঘাত বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।