পা-বিহীন টিকটিকিসহ শতাধিক নতুন প্রজাতির আবিষ্কারের বছর ২০২৩
এ বছর লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অব সায়েন্সের গবেষকরা প্রায় এক হাজার নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। তাদের এ আবিষ্কার প্রমাণ করে পৃথিবীতে অনেক বিস্ময়কর প্রাণি আছে যেগুলো এখনও আমাদের কাছে অজানা।
যুক্তরাষ্ট্রের এনড্যানজার্ড স্পেসিস অ্যাক্টের ৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বছরে বিজ্ঞানীরা এ প্রজাতিগুলোর আবিষ্কার করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অব সায়েন্সেসের নির্বাহী পরিচালক স্কট স্যাম্পসন জানান, এই আইন ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ভিদ এবং প্রাণিদের জন্য সুরক্ষা প্রদান করে, যা শত শত প্রজাতিকে বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
স্কট স্যাম্পসন আরও জানান, বাসস্থান ধ্বংস এবং দূষণের মতো মানব ক্রিয়াকলাপের জন্য এখনও এক মিলিয়ন প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। তিনি পৃথিবীর বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য প্রজাতিগুলো নথিভুক্ত করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
বিজ্ঞানীরা যে ৯৬৮টি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্বে অজানা ডাইনোসর, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি, বিটল, মথ, শামুকের মতো বিশেষ সামুদ্রিক প্রাণি, গেকো, মাছ, ব্যাঙ, মাকড়সা, গাছপালা, ছত্রাক, কৃমি এবং একটি পা বিহীন টিকটিকি।
কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণকারী ভিমরুল (ওয়াস্প)
বিজ্ঞানীরা সম্ভবত ২০২৩ সালকে ভিমরুল পোকার বছর হিসেবে স্মরণ করবেন। এই বছর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষকরা ৮১৫টি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে ৬১৯টি বিভিন্ন ধরনের পরাগায়নকারী, শিকারী এবং পরজীবী ভিমরুল।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের দুই বৈজ্ঞানিক সহযোগী ডক্টর জন নয়েস এবং ক্রিস্টার হ্যানসন ২০২৩ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা কোস্টারিকাতে মৌমাছি, পিঁপড়া এবং ভিমরুল নিয়ে গবেষণা করছেন।
নয়েসের মতে, নতুন প্রজাতির বর্ণনা করা অপরিহার্য। কারণ, এটি পরিবেশের ওপর তাদের প্রভাব বুঝতে সাহায্য করে। সদ্য আবিষ্কৃত ভিমরুলের প্রজাতিগুলো কিছু প্রাণবন্ত ধাতব রঙ প্রদর্শন করে। যেমন নীল, বেগুনি এবং কমলা। টিভি সিরিজ 'ডক্টর হু' এর ৬০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সম্মতি জানাতে নয়েস অনুষ্ঠানটির কাল্পনিক ভিলেন ডালেক ও তাদের স্রষ্টার নামানুসারে ভিমরুলের একটি বংশের নামকরণ করেছিলেন।
নয়েসের মতে, ভিমরুলকে দংশনকারী পোকা হিসেবে জানলেও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গত ছয় দশকে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে তিনটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ভিমরুল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। একটি আফ্রিকার ৩০০ মিলিয়ন মানুষের জন্য সম্ভাব্য অনাহার প্রতিরোধ করেছে। অন্যটি থাইল্যান্ডের রেইনফরেস্টকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এবং তৃতীয়টি টোগোতে অর্থনৈতিক পতন এড়াতে সহায়তা করেছে।
পা বিহীন টিকটিকি (লিজার্ড)
অ্যাঙ্গোলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত সেররে দে নেভের ঢালে একটি নতুন পা-বিহীন টিকটিকির একটি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। সাপের মতো দেখতে এ টিকটিকিকে স্কিনকও নামেও ডাকা হয়। এটি পোকামাকড় ও ছোট শিকার ধরার জন্য পাতা ও বনের মাটিতে লুকিয়ে থাকে। নামিব মরুভুমির উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই পর্বতে বিচিত্র গাছপালা ও প্রাণিদের আবাস।
ভার্জিনিয়া চিড়িয়াখানার মতে, স্কিনগুলো সাপের থেকে আলাদা। কারণ তাদের বাইরের কান খোলা এবং চোখের পাতা রয়েছে, যা নড়াচড়া করতে পারে। যদিও বেশিরভাগ স্কিনক একই রঙের, তবে সদ্য আবিষ্কৃত স্কিনকটির (বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাকনটিয়াস মুকওয়ান্দোর) গলায় গোলাপী বৃত্ত রয়েছে।
একাডেমি অব সায়েন্সের গবেষণা সহযোগী অ্যারন বাউয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, "এই পর্বতে বহু নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণ করে যে এই জাতীয় স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য বিবেচনা করা দরকার।"
উদ্ভট যত গাছপালা
মেক্সিকোর দুরাঙ্গোতে ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সিয়েরা মাদ্রে অক্সিডেন্টাল পর্বতমালাযর একটি বিরল সাকুলেন্ট প্ল্যান্ট (রসালো উদ্ভিদ) নিয়ে গবেষণা করতে একাডেমি অব সায়েন্সেস গবেষকদের সাথে কাজ করেছেন।
পাহাড়ের পাশে জন্মানো গাছটি স্থানীয় ওডাম আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। ওডাম সম্প্রদায়ের লোকেরা পাতা ও কাণ্ডসহ গাছটিকে দা'নপাকাল বলে থাকে, স্থানীয় ভাষায় দা'নপাকাল অর্থ টাক, নগ্ন বা পিচ্ছিল।
গবেষকরা এই সাকুলেন্ট প্যাচিফাইটাম উদ্ভিদটির নাম দিয়েছেন 'ওডাম'। স্থানীয় ওডাম সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান ও তাদের সাথে এ উদ্ভিদের এক ধরনের সংযোগ আছে- এমনটা বোঝাতেই এই নাম।
আরেকটি আবিষ্কারের মাধ্যমে গবেষকরা কোস্টারিকাতে একটি ফুলের ভুল পরিচয়ের বিষয়টি শনাক্ত করেছেন। দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফুলটিকে মেক্সিকোতে পাওয়া একটি প্রজাতির বলে ধারণা করা হতো। তবে নতুনভাবে শনাক্ত করে এটির দেওয়া হয়েছে স্টেনোস্টেফানাস পুরপিউরিয়াস, যা মেক্সিকোতে পাওয়া স্টেনোস্টফানাস সিমভাটিকাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফুলগুলো বিভিন্ন রঙের হয় এবং কোস্টারিকান এই ফুলে একটি সমতল পাপড়ি অনুপস্থিত থাকে। এটি প্রজাপতি এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের জন্য ল্যান্ডিং প্যাড নামে পরিচিত। তাদের পরিবর্তে হামিংবার্ড সম্ভবত এই ফুলের পরাগায়ন করেছে।
বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক রকার্ড ক্রিবেল এক বিবৃতিতে বলেন, "মেক্সিকো থেকে জীবন্ত উদ্ভিদের চিত্রগুলোর সাথে পাশাপাশি তুলনা না করা পর্যন্ত আমি কখনোই কোস্টারিকান নমুনাগুলোর শনাক্তকরণ নিয়ে প্রশ্ন করিনি। মৃত, শুকনো নমুনা নিয়ে কাজ করার সময় উভয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে।"
অতীতকে নতুন করে ফিরে পাওয়া
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষকরা জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করে চারটি নতুন প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় পাখি শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে ডাইনোসরের সময় বসবাসকারী পাখিও রয়েছে। বছরের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি হলো পৃথিবীতে থাকা বৃহত্তম পেঙ্গুইন কুমিমানু ফোরডিসি। আনুমানিক ৩৩০ পাউন্ড (১৫০ কিলোগ্রাম) ওজনের এই ডানাবিহীন পাখিগুলো প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগেও জীবিত ছিল।
আইল অব উইট-এ একটি অজানা ধরনের সাঁজোয়া ডাইনোসর প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। ডাইনোসর দ্বীপ নামে পরিচিত, 'আইল অব উইট' যুক্তরাজ্যের ডাইনোসরের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়ার সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৪০ মিলিয়ন বছর আগে দ্বীপে বসবাসকারী এই অ্যাঙ্কিলোসরকে ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অধ্যাপক পল ব্যারেটের সম্মানে 'ভেকটিপেল্টা ব্যারেটি' নামকরণ করা হয়।
শিশুতোষ বইয়ের লেখক এবং চিত্রশিল্পী বিট্রিক্স পটারের নামানুসারে, গবেষকরা একটি ৪০০ মিলিয়ন বছর বয়সী ছত্রাকের নাম দিয়েছেন। প্রাচীনতম এ ছত্রাকটি জীবাশ্মযুক্ত উদ্ভিদের শিকড়, পোটেরোমাইসিস অ্যাস্টেরক্সিলিকোলাকে সংক্রমিত করে।
বিট্রিক্স পটার শুধু একজন লেখক ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন মাইকোলজিস্টও। ছত্রাক নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন তিনি।