শান্তি বা আলুর চিপস: ২০২৪ সালকে ঘিরে গাজার মানুষদের ছোট-বড় স্বপ্ন
আল-আকসা মার্টারস হসপিটালের কাছে গড়ে উঠা দের এল-বালাহ ক্যাম্পে বাচ্চারা ছুটোছুটি করে বেড়ায়, জিনিসপত্র ধার নেয়, খবর আনা-নেওয়া করে কিংবা খেলার সাথী খোঁজে।
আল জাজিরা এই ক্যাম্পের কয়েকজন ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলেছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার মাঝে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে ২০২৪ সালকে ঘিরে তাদের আশা ও আশঙ্কার কথা।
আইদা এল-শৌলি, ২৯, জাবালিয়া
আইদা এল-শৌলি এবং তার পরিবারের কোনো তাঁবু নেই। তার পরিবর্তে তারা চারটি খুঁটির সঙ্গে কাপড় টানিয়ে কোনোরকমে একটি অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছেন। তাদের আপাতত এভাবেই বাস করতে হবে।
আইদা মাটিতে বসে আটা গোলাচ্ছিলেন, সন্তানদের জন্য রুটি বানাবেন। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে তাকে ঘিরে বসেছিল। সঙ্গে তাদের সবচেয়ে ছোট বোন, মাত্র ছয় সপ্তাহ বয়স তার। আইদা নুসেইরাতে জাতিসংঘ ত্রাণ এবং পুনর্বাসন সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিচালতি একটি স্কুলে এই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে পালিয়ে এসে স্কুলটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল আইদাকে।
"আমি জাবালিয়া ক্যাম্পে ছিলাম কিন্তু সেখান থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। এরপর মুঘরাকায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে নুসেইরাত এবং বর্তমানে দের এল-বালাহতে এসে আশ্রয় নিয়েছি।
"আমি গর্ভবতী অবস্থায় মালপত্র ভর্তি একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে মুঘরাকা থেকে নুসেইরাত পর্যন্ত চার কিলোমিটার হেঁটে এসেছি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমার ছেলে হাত ধরে তার দাদাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। খুবই ভয়াবহ এক যাত্রা ছিল এটি।
"তারপর স্কুলটায় পৌঁছে দেখি মানুষের ভিড়। সবখানেই মানুষ গিজগিজ করছে। চারদিকে ধুলোবালি আর বাথরুমগুলোর করুণ দশা।
"সবকিছু দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। তারপরেই আমার সন্তানের জন্ম হয়।"
চারদিকে মৃত্যু আর ধ্বংসের মিছিলের মধ্যেও আইদা তার কন্যার জন্য "সেবু" (শিশুর জন্মের সাতদিন পর আয়োজন করা উৎসব) পালন করেন।
"আমরা সামান্য উদযাপন করেছি। আমার কাছে আমার সন্তানকে পরানোর জন্য কাপড়ও ছিলনা। তার গায়ের পোশাকটা দান হিসেবে পেয়েছি। তীব্রভাবে চাই এই যুদ্ধ শেষ হোক যাতে আমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারি। আমি জানি, আমাদের আসলে আর কোনো ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই। তারপরওতো আমরা আমাদের জায়গায় থাকতে পারব। প্রতিবেশীরা একে অন্যকে সাহায্য করে কিন্তু এখানে তো আমরা কেউ কাউকে চিনিনা।
"আমার নিজের পরিবার উত্তরে থাকে কিন্তু আমি তাদের কোনো খবরই জানিনা। তারা কি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে? কে জানে? গতকাল যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা আবার চালু হলো, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি। যদি তারা মারাও যায়, সেটাও আমি জানতে চাই। কিন্তু একেবারে কোনো খবর জানতে না পারাটা খুবই কষ্টের।"
"আমরা কী করেছি? কী কারণে আমাদের সঙ্গে এমনটা হলো? আমাদের আর এ যুদ্ধ নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই যুদ্ধ শেষ হলে আমাদের মানসিক কাউন্সেলিংয়েরও দরকার হবে।
"দুনিয়ার মানুষের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন: এই যুদ্ধ যদি শেষও হয়, তারপরে আমরা কী করব? আমরা কীভাবে বাঁচব? আমরা কি খোলা প্রান্তরে ঠান্ডায় জমে মারা যাব? আমাদের ঘরবাড়ি কারা আবার বানিয়ে দেবে?"
আবু তারিক, ৭৬, সুজায়ি
১০ সন্তানের জনক আবু তারিক যুদ্ধবিরতির পর সুজায়ি ছেড়ে নুসেইরাত ক্যাম্পের ইউএনআরডাব্লিউএ-এর স্কুলে আসেন। সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে তিনি দের এল-বালাহতে এসেছেন।
তিনি বলেন, "স্কুলটা খারাপ ছিল না, সেখানে বাথরুমসহ অন্যান্য রুম ছিল। কিন্তু একদিন আকাশ থেকে লিফলেট ফেলা হলো এবং স্কুলপ্রধান আমাদের জানালেন তারা আর আমাদের নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব নিতে পারবেন না। আমাদের নিজেদের দেখভাল নিজেদেরই করতে হবে।
"দের এল-বালাহতে আমার মেয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের বাড়িতেও উদ্বাস্তু হওয়া আরও অনেক মানুষ এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। তাই আমি আমার ছেলেরা ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে থাকার জন্য চলে আসি।
"আমি সব ধরনের পরিস্থিতির কথা ভেবেই নানা পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল: অসুস্থতা, দারিদ্র্যের পাশাপাশি হয়তো যুদ্ধের মুখেও পড়তে হতে পারে। কিন্তু এরকম ভয়াবহ কোনো কিছু আসলে আমার কল্পনাতেও ছিলনা। আমরা যেরকম দুঃখ, মৃত্যু এবং ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছি এটা আসলে অন্য কেউ সহ্যই করতে পারবে না।
"আমার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, তারপরও আমি সেখানেই ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমাকে যদি বলা হয় যে আমি ফিরতে পারব সেখানে, আমি ভোরে উঠেই চলে যাব… কিংবা এখনই বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দেব। আমি আমার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হলেও থাকতে চাই, সেটাই আমার জন্য আনন্দের।
"আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছি গেল বছরের চেয়ে এ বছরটা যেন আরও ভালো হয়। প্রার্থনায় জানিয়েছি, তাদেরকে উপরওয়ালা হেদায়েত করুক যাতে তারা এই গণহত্যা ও যত্রতত্র বোমাবর্ষণ বন্ধ করে। আর কি-ই-বা বলতে পারি বা করতে পারি? আমরা মানুষ এবং তারাও তো আমাদের মতো মানুষ। তিনি আমাদেরকে যেমন বানিয়েছেন, তাদেরকেও বানিয়েছেন। তাই আমাদের আসলে সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।
"আমি এটাও আশা করি সমস্ত দুনিয়ার মানুষ আমাদের দয়া এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।"
নূর এল-বায়েদ, ৭, জাবালিয়া
নূর এল-বায়েদ এবং তার পরিবার দের এল-বালাহতে আশ্রয় নিয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। নুসেইরাতের উদ্দেশ্যে জাবালিয়া ছাড়ার পর এটি তাদের দ্বিতীয় আশ্রয়স্থল।
সে জানিয়েছে কীভাবে বোমা হামলার সময় সে ভয়ে কুঁকড়ে যেত, ভারী সমরাস্ত্রের শব্দ এবং বিস্ফোরণের আওয়াজে প্রচণ্ড ভয় পেত। স্কুলের কথাও ভুলতে পারছে না ছোট্ট এ শিশু।
নূর তার প্রিয় মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। পরিবারেরকে কখন 'শহীদ' হয়ে যাবে, এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে বোমাহামলায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু দেখা নূর।
"আমি চাই পরের বছরটি শুভ হোক। আমি খেতে চাই, পানীয় চাই।
"যুদ্ধের আগে আমি চিপস, চকলেট এবং জুস কিনতে পারতাম। আমি সেগুলো খেতে চাই," নূরের সবচেয়ে প্রিয় পনির দেওয়া আলুর চিপস; কিন্তু এখন আর তা খেতে পারছে না সে।
তবে তার আশা নতুন বছরে সে ঠিক ঠিক পনির-চিপস, চকলেট আর স্ট্রবেরি জুস খেতে পারবে। সেগুলো নিজের বাড়িতে শান্তিতে বসে খেতে চায় সে।
"আর," কাঁপা গলায় বলে উঠল নূর এল-বায়েদ, "আমি চাই তোমরা সবাই বেঁচে থাকো।"