ইন্ডিয়ান হোটেল হত্যাকাণ্ড থেকেই আগাথা ক্রিস্টি লেখেন ‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ উপন্যাস
'অপরাধের রানি' হিসেবে বিখ্যাত আগাথা ক্রিস্টি সুপরিচিত 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান', 'মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস', 'দ্য মার্ডার অভ রজার অ্যাকয়েড' এর মতো রহস্য-কাহিনির জন্য। তবে আগাথা ক্রিস্টিকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি এনে দিয়েছে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র এরকুল পোয়ারো। এ গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখা উপন্যাস 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'ও পাঠকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। ১৯২০ সালে পারিবারিক কলহের জেরে এমিলি ইঙ্গলথর্প নামে এক ধনী নারীর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি লেখা হয়। আর এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তার থেকে ২০ বছর ছোট স্বামী এভলিন হাওয়ার্ডের দিকে সন্দেহের তির ঘোরানো হয়।
এ উপন্যাসে আগাথা ক্রিস্টি তার আইকনিক চরিত্র, খেয়ালি গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন। তার অন্যান্য গল্পেও একাধিক সন্দেহভাজন চরিত্র, রহস্যেঘেরা টুইস্ট, নানা লুকানো তথ্য এবং সবশেষে নাটকীয় উদঘাটনের মাধ্যমে অপরাধীকে উন্মোচিত করা হয়। তবে 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস' বইটিকে যা আলাদা করে তোলে, তা হলো এ বইয়ের কাহিনি এক শতাব্দী আগে উত্তর ভারতের পাহাড়ি এলাকা, জনপ্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র মুসৌরিতে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব জীবনের হত্যাকাণ্ড থেকে অনুপ্রাণিত বলে বিশ্বাস করা হয়।
১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে ৪৯ বছর বয়সী ফ্রান্সেস গারনেট ওর্মেককে একজন আইরিশ ব্যারিস্টারের মালিকানাধীন হোটেলে স্যাভয়-এ নিজ কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, ওর্মেককে সায়ানাইড-ভিত্তিক বিষ প্রুসিক এসিড দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তার বন্ধু ইভা মাউন্ট স্টিফেনসের (৩৬) বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
১৯১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদপত্র উল্লেখ করেছিল যে, এই মামলা এর অদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো 'মুসৌরি হত্যার বিচার', 'হোটেল রহস্য'-এর মতো শিরোনাম ব্যবহার করে বিচারের বিশদ বিবরণ ছেপেছিল।
মুসৌরিতে বসবাসকারী ভারতীয় লেখক রাস্কিন বন্ড তার একটি প্রবন্ধে আগাথা ক্রিস্টির প্রথম বইয়ের সাথে বিখ্যাত এই হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র দিয়েছেন। বন্ডের মতে, মামলাটি ওই সময় বেশ আলোচনায় থাকায় ক্রিস্টি তার বইয়ে এই অপরাধের বিভিন্ন পরিস্থিতি নিজের মতো করে ব্যবহার করেছিলেন।
রিপোর্ট অনুসারে, ওর্মে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন এবং লখনৌ শহর থেকে আসা আধ্যাত্মবাদী স্টিফেন্সের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন। স্টিফেনসের কাছ থেকে নিঃসঙ্গ মহিলা ওর্মে জ্যোতিষবিদ্যা এবং অন্যান্য গুপ্তবিদ্যা শিখেছিলেন বলে জানা গেছে।
দুজনে কিছু সময়ের জন্য হোটেল স্যাভয়ে একসাথে ছিলেন। সেই সময় স্টিফেনস দাবি করেছিলেন, তিনি অসুস্থ ওর্মের দেখাশোনা করেছিলেন। কিন্তু বাদীপক্ষ স্টিফেনসের বিরুদ্ধে ওর্মেকে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ আনে। এছাড়া স্টিফেনস ওর্মে থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ, তিনটি নেকলেস এবং অন্যান্য গহনা হাতিয়ে নেন—এরকম অভিযোগ ও আনা হয়।
অন্যদিকে আসামি পক্ষ দাবি করে, ওর্মে 'নিঃসঙ্গতা' ও নিজের অসুস্থতা থেকে আত্মহত্যা করেছেন।
অসংখ্য রহস্যের কারণে মামলাটি পুলিশসহ অনেককে বিস্মিত করেছিল। প্রথমত, তদন্তে জানা যায়, ওর্মের মৃত্যুর আগে স্টিফেন্স লাখনৌ চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, যে কক্ষে ওর্মের মৃতদেহ পাওয়া গেছে সেটি ভেতর থেকে তালাবদ্ধ ছিল, যা রহস্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।
পুলিশ ওর্মের কক্ষ থেকে ঘুমের ওষুধের বোতল এবং আর্সেনিক ও প্রুসিক অ্যাসিডের দুটি লেবেল ছাড়া আর কোনো ওষুধ পায়নি।
১৯০০-এর দশকের গোড়ার দিকে, ক্রেতাদেরকে ওষুধ কেনার জন্য কেমিস্টের কাছে স্বাক্ষর দিতে হতো। তবে প্রসিকিউশন উল্লেখ করেছিল যে প্রুসিক অ্যাসিডের স্বাক্ষরটি ওর্মের চিঠির স্বাক্ষরের সাথে মেলে না।
প্রসিকিউশন আরও জানায়, স্টিফেনস ছয় মাস আগে তার এক বন্ধুর সাথে কথোপকথনে ওর্মের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এছাড়া ওর্মে তার চিকিৎসককে বিয়ে করার এবং বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তার কাছে রেখে যাওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন।
তবে প্রতিপক্ষ জোর দিয়ে বলে যে, স্টিফেনস ওর্মের 'সবচেয়ে নিবেদিত সঙ্গী' ছিলেন এবং এমন কোনো প্রমাণ নেই যে তিনি তার বন্ধুকে বিষ কিনে দিয়েছিলেন বা প্রয়োগ করেছিলেন।
অবশেষে স্টিফেনসকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়, বিচারক মন্তব্য করেন যে 'মিস ওর্মের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না।'
ক্রিস্টির 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস' বইটি বাস্তবজীবনের এই ঘটনাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওর্মের মতো এমিলি ইঙ্গলথর্পও বিষক্রিয়ায় মারা যায় এবং একইভাবে তার প্রাণহীন দেহটি ভেতর থেকে তালাবদ্ধ একটি ঘরে পাওয়া যায়। গল্পের উপসংহারে জানা যায় যে অপরাধী তার সঙ্গী এভলিন। এরকুল পোয়ারো প্রমাণ করেন যে এভলিন ছদ্মবেশে একটি জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করে বিষটি কিনেছিলেন এবং এই হত্যার পেছনে তারও অর্থের লালসা ছিল।
অনেকটা স্টিফেন্সের মতো এভলিনও এমিলির মৃত্যুর আগে ইঙ্গলথর্পের বাসভবন থেকে চলে যান। উপন্যাসটিতে অপরাধের জটিলতা পাঠকদেরকে অবাক করে দেয়। আর রহস্য উন্মোচনের একমাত্র চাবিকাঠি থাকে গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর হাতে।
কয়েক দশক পরও বাস্তব ও বইয়ের মামলা দুটোর মধ্যকার মিল ভক্তদের কৌতূহলী করে তোলে। ভারতীয় অপরাধ লেখক মঞ্জিরি ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক আগাথা ক্রিস্টি ফেস্টিভালে ক্রিস্টির প্রথম উপন্যাস এবং মুসৌরি হত্যার মধ্যে 'আকর্ষণীয় সংযোগ' নিয়ে বলেছিলেন।
অবশ্য আগাথা ক্রিস্টিই একমাত্র লেখক না যিনি এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেসিল ওয়ালশ ব্রিটিশশাসিত ভারতের আগ্রা ও অওধ প্রদেশের আওতাধীন আগ্রায় ঘটে যাওয়া একটি অপরাধের কাহিনি তুলে ধরে পাঠকদের হতবাক করে দেন। 'দি আগ্রা ডাবল মার্ডার: আ ক্রাইম অভ প্যাশন ফ্রম দ্য রাজ'-এ তিনি লিখেছেন কীভাবে মিরাট শহরে বসবাসকারী ইংরেজ নারী অগাস্টা ফুলাম এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ড. ক্লার্ক যথাক্রমে তাদের স্বামী এবং স্ত্রীকে বিষপ্রয়োগ করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যাতে তারা একসঙ্গে থাকতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো উনিশ শতকে ভারতেও বিষক্রিয়ার ঘটনা অনেকটা সাধারণ ছিল। ওই সময় বিষাক্ত পদার্থ, বিশেষত আর্সেনিকের বিক্রয় অনিয়ন্ত্রিত ছিল। ডেভিড আর্নল্ড তার বই 'টক্সিক হিস্টোরিজ: পয়জন অ্যান্ড পলিউশন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া'তে দেখিয়েছেন কীভাবে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিষ আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল বিষের বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।
বইটিতে আর্নল্ড উল্লেখ করেছেন যে, ১৯১৪ সালে ইউপি (যুক্তপ্রদেশ) সরকার যখন বিষ আইন পর্যালোচনা করেছিল, তখন তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রদেশে দুটি কুখ্যাত বিষক্রিয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিল—একটি ওর্মে হত্যা, অন্যটি ফুলাম-ক্লার্ক মামলা।
সত্য অপরাধ ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র, পডকাস্ট এবং ওয়েব দর্শকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়। তবে আগাথা ক্রিস্টির 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস' সর্বদা পাঠকদের মনে আলাদা স্থান ধরে রাখবে।