১৪ শতকের ‘বেস্টসেলার’ মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনী!
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে 'ইউনিকর্ণ' বা রূপকথার শিংওয়ালা ঘোড়া দেখেছে বলে দাবি করে এমন ব্যক্তিকে কি বিশ্বাস করা যায়? ১৪শ শতকে এমন আরো অনেক প্রশ্ন ওঠে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলোকে নিয়ে। এ সময় তার 'দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো' ভ্রমণকাহিনী ছিল বেস্টসেলার। বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এই বইটি। এমনকি সারা ইউরোপ জুড়ে খুঁজে পাওয়া যেত বইটি।
মার্কো পোলোর এসব গল্পের মাধ্যমেই ইউরোপীয়রা প্রথম পরিচিত হয় সিল্ক রোড, মসলা, স্বর্ণ এবং দামী পাথরের এক পথের সাথে। তার বইয়ে উঠে এসেছে যুদ্ধরীতি যা পাঠকদের বইটি পড়তে আরো উৎসাহিত করে। তার বইয়ের গল্পগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও পাঠকদের আনন্দ দিয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারি পূর্ণ হলো মার্কো পোলোর মৃত্যুর ৭০০ বছর। ১৩২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন ভেনিসের প্রখ্যাত বণিক, অনুসন্ধানকারী লেখক এবং স্ব-ঘোষিত এই নৃতাত্ত্বিক। তবে প্রশ্ন রয়েই যায়, তিনি কি আসলেই দেখেছিলেন রূপকথার ঘোড়া ইউনিকর্ণ?
ভেনিস ছিল সেই সময়ের নিউইয়র্ক শহর, বলছিলেন ইতিহাসবিদ পিয়বালভিস জোরজি। এটা ছিল মুক্তমনা এবং বহু সংস্কৃতির এক মহানগর। সেটি ছিল প্রাচ্য ও পশ্চিমের বাণিজ্যের এক প্রাণবন্ত মিলনমেলা যেখানে বাণিজ্যই ছিল একমাত্র ধর্ম। আর এই শহরেই বাণিজ্যে সেরা ছিল পোলো পরিবার।
পোলোর বাবা নিকোলো ও তার চাচা মাতেওর কন্সটান্টিনপোলে ছিল নিজেদের বাণিজ্যিক অফিস। গ্র্যান্ড ক্যানালের কাছেই ছিল তাদের নিজস্ব বাড়ি। গ্রিস, ভেনিস অধিগ্রহণের আগেই তারা সব বিক্রি করে দিয়ে এগোতে থাকে পূর্ব অঞ্চলের দিকে। খুঁজতে থাকে নতুন বাজার।
পরিবারটি সিল্ক, মসলা, রত্নপাথর এবং সুগন্ধিসহ নানা ধরনের পণ্যের বাণিজ্য শুরু করে। কিছু বছর পর ফিরে এসে ১২৭১ সালে চীন দেশে ভ্রমণ করে তারা। এবার তাদের সঙ্গে ছিলেন ১৭ বছর বয়সী মার্কো পোলো।
পোলোর বর্ণনা অনুযায়ী, 'আকড়ি' বা বর্তমান ইসরায়েল থেকে মঙ্গল সম্রাট কুবলাই খানের দরবার খানবালিক' বা বর্তমান বেইজিং পর্যন্ত ব্যপ্ত তাদের তিন বছরের ভ্রমণে তারা অতিক্রম করেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার অনেকাংশ। চীনে তাদের ২০ বছরের জীবনে নানা বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল পোলো পরিবার। কাজ করেছে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবেও।
তারা সুমাত্রা এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, ভারতের উপকূলীয় অঞ্চল এবং আদেন ও ইস্তাম্বুল হয়ে ফেরত আসে ভেনিসে। পোলো তখন ৪০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তি। এর ঠিক এক বছর পরেই, উপকূলীয় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ভেনিস এবং জেনোয়ার মধ্যকার যুদ্ধে পোলো বন্দী হন জেনোভিসদের হাতে। জেলে তার সাক্ষাৎ হয় রাস্টিচোলা দা পিসার সাথে। পোলোর বিশ্বভ্রমণের গল্পে মুগ্ধ হন এই লেখক এবং সম্পাদক। এসব গল্পের অধিকাংশই ইউরোপের লোকেদের অজানা। সেজন্যই তারা এসব গল্প লেখার ব্যবস্থা করেন।
পোলোর ভ্রমণকাহিনী বইটি সাড়া ফেলে দেয় প্রথমেই। গল্পগুলো এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, বইটি অনুদিত হয়েছে অনেকগুলো ভাষাতে। গত কয়েক শতক ধরে, ফিলোলজিস্টদের কাছে এক অনবদ্য ধাঁধা হিসেবে রয়ে গিয়েছে এই বইটি। অনুবাদ থেকে বহুবার নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি। আর এভাবেই কাল পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে আসল বইটি।
ভেনিসের "ইউনিভার্সিটি কা' ফোসকারি" তে মার্কো পোলোর উপর পড়াশোনা করছেন ইউজেনিও বার্গিও। তিনি মার্কো পোলো বইয়ের ভাষান্তর থেকে রূপান্তরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ধরুন বইটির ফরাসি অনুবাদ থেকে অনূদিত হয়েছে এমিলিয়া রোমাগনা এবং ভেনেতার আঞ্চলিক ভাষায়। তা থেকে তুসকান ভাষায়। এবার তুসকান ভাষা থেকে ল্যাটিনে অনুদিত বইটি মূল বইয়ের ঠিক কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে?
তা জানা মুশকিল হলেও, বার্গিও এবং তার দল এ বছরের শেষের দিকে মার্কো পোলোর ভ্রমণের সম্পূর্ণ সম্পাদনা প্রকাশ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
পোলোর মূল বইটি হারানোর সাথে সাথে ১৬শ শতকে আগুনে পুড়ে গেছে তাদের পারিবারিক বাড়িটিও। হারিয়ে গেছে ভেনিসের স্যান লরেঞ্জ গির্জায় পোলোর সমাধি।
মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনীগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। তিনি কি আসলেই চীন দেশে গিয়েছিলেন? তাহলে কেন তার গল্পে চা কিংবা গ্রেট ওয়ালের কোন উল্লেখ নেই? বহু বছর বাণিজ্য করলেও চীনা ভাষা জানতেন না পোলো। এসব বিষয় নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা হলেও, বার্গিওর মতো নতুন অভিজ্ঞদের কাছে ব্যাখ্যা পাওয়া গেল এর।
তাদের মতে মার্কো 'ওয়াইন' অথবা 'কফি' হলে হয়তো উল্লেখ করতেন। কিন্তু 'চা' তার কাছে অন্যান্য ইউরোপীয় পর্যটকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এছাড়া চীনা ভাষা সেসময়কার শাসকগোষ্ঠীর ভাষা না হওয়ায় এই ভাষা না জানারই কথা পোলোর। 'এবং সেসময় গ্রেট ওয়ালের নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত ছিল' বলে যুক্ত করেন জরজি।
এছাড়াও, পোলোর ভ্রমণের সত্যতা মেলে আইনী দলিলপত্রে। স্বামী মারা গেলে, পণ ফেরতের দাবিতে মামলা করেন পোলোর মেয়ে। সেখানেই তার সম্পত্তির বিবরণের মধ্যে উল্লেখ করা হয় 'সোনালী পাসপোর্টের', যা তার বাবা মার্কো পোলোকে দিয়েছিলেন সম্রাট কুবলাই খান। এছাড়া চীনের তৎকালীন অর্থ ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন পোলো তার বইয়ে। তবে কোনো কোনো অভিজ্ঞদের মতে 'সরকারি প্রতিনিধি' হওয়ার বিষয়টি নিজের ব্যাপারে বাড়িয়ে বলেছেন পোলো।
ধারণা করা হয়, পোলো ছিলেন একেবারে প্রথম দিকের নারীবাদী। তার সম্পত্তির সব কিছুই তিনি তার স্ত্রী এবং মেয়ের নামে দিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও সেসময়ে ভেনিসের বণিকেরা বাণিজ্যে যাওয়ার আগে তাদের স্ত্রী সন্তানদের কাছেই দ্বায়িত্ব দিয়ে যেত সকল সম্পত্তির।
মধ্যযুগীয় পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোন প্রকার মতামত প্রতিষ্ঠা ছাড়াই ব্যাখ্যা করেন 'টেবেট' বা বর্তমানে তিব্বতের নারীদের কথা। তার গল্পে উঠে আসে ভারতের 'নারী দ্বীপের' কথা যেখানে পুরুষরা থাকতে পারে তিন থেকে চারমাস। বর্ণনা করেন কীভাবে টারটারের এবং মধ্য এশিয়ার নারীরা পুরুষদের মতোই ঘোড়ায় চড়তে পটু ছিল।
উদার মনের মানুষ ছিলেন পোলো। তার আগ্রহ এবং কৌতুহল ছিল অন্যরকম। পোলো সাপুরগান (বর্তমান আফগানিস্তানের শেবেরঘান) শহরের তরমুজ বিশ্বের সেরা 'মধুর চেয়েও মিষ্টি' হিসেবে বর্ণনা করেছে। দক্ষিণ ভারতের খাদ্য ও সংস্কৃতি নিয়েও বর্ণনা আছে পোলোর গল্পে। তিনি কুবলাই খানের পথচারীদের সুবিধার্থে রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থাকে প্রশংসা করেছেন।
পোলো তার বইয়ে তার দেখা বহু সংস্কৃতিকে তুলে এনেছে। এক্ষেত্রে তার নিজের সংস্কৃতিকেই শুধু না; বরং সকল সংস্কৃতির সুন্দর ও আশ্চর্য সব বিষয়কে প্রশংসা করেছে তার বইয়ে।
মার্কো পোলো যেসময় ভ্রমণ করেছেন তখন পুরো বিশ্ব ছিল মানুষের কাছে অজানা এবং অদেখা এক আশ্চর্য জায়গা। ভেনিস থেকে প্রথমবারের মতো বেরিয়ে পৃথিবীর অনন্য সব বিস্ময় দেখেছেন পোলো।
পোলো আমাদের উদার এবং কৌতুহলী হতে শেখায়। অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মেলবন্ধন তৈরি করতে শেখায় 'শান্তি এবং বিস্ময়ের বার্তাবাহক' এই পর্যটক।
তবে বিস্ময়ের কথা বলতে গেলে, সত্যিই কি তিনি দেখেছিলেন পৌরাণিক সব প্রাণী? এসব পৌরাণিক প্রাণীদের মধ্যে আছে, আগুনে থাকতে পারে এমন এক টিকটিকি জাতীয় মধ্যযুগীয় প্রাণী স্যালাম্যান্ডার। যা তিনি দেখেছিলেন 'চিঙিটালাসে' (উত্তর চীন)।
আর 'ইউনিকর্ণ'? পোলো তার গল্পে যে পৌরাণিক প্রাণীটির বর্ণনা দিয়েছিলেন তা দেখতে বন্য শুকরের মতো, কদাকার এবং হিংস্র। প্রাণীটির শিং ছিল কালো এবং পুরু। তিনি আসলে সত্যিই দেখেছিলেন প্রাণীটিকে। তবে বর্তমানে এই প্রাণীটি পরিচিত 'গণ্ডার' নামে।