সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ ব্যবহারকারীর জন্য যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে ফিলিস্তিনিরা
বড়দিনে মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরে মোতাজ আজেইজা নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) যুদ্ধের একটি ভয়ানক মুহূর্তের কথা পোস্ট করেন।
একটি কোয়াডকপ্টার তার বাড়ির দরজার খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায়। মোতাজ আশঙ্কা করেছিলেন, হয়ত তার বাড়িটি এখন ইসরায়েলি বিমান হামলার শিকার হতে চলেছে।
মোতাজ একজন ফটো সাংবাদিক। তিনি যুদ্ধের বিভিন্ন খবরাখবর ও ছবি অনলাইনে নিয়মিত শেয়ার করেন। এ কাজের জন্য তিনি এর আগে হুমকির শিকারও হয়েছেন। তাই তার বিশ্বাস তাকে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য ইসরায়েলি বাহিনীর যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
২৪ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের ওই পোস্টে বহু মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অনেকে তার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, "আমি মোতাজের জন্য খুব ভয় পাচ্ছি।" আরেকজন লিখেছেন, "আমি আশা করি মোতাজ ঠিক আছে।" একজন লিখেছেন, "মোতাজের জন্য দোয়া করো।"
আশঙ্কা প্রকাশকারীদের একজন নুর। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাালিফোর্নিয়ায় একটি মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মোতাজের অনলাইনে করা পোস্টগুলো ফলো করছেন। গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতায় কীভাবে গাজার এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেসব চিত্র তুলে ধরেছেন মোতাজ।
মোতাজ যখনই কোনো পোস্ট করেন, সাথে সাথেই নুরের ফোনে সেটির নোটিফিকেশন পৌঁছে যায়।
নুর সিএনএনকে বলেন, "আমাদের অনেকের জন্য প্রায় মনে হয় তিনি (মোতাজ) আমাদের ভাই। তিনি একজন বন্ধু এবং আমরা তাকে বাস্তব সময়ে কষ্ট পেতে দেখছি।"
নূর ফিলিস্তিনি নন। এমনকি তিনি কখনো গাজা যানওনি। তার পরিবার ইরাকি। যখন মোতাজ বলেছিলেন যে তাকে তার কাজের জন্য মেরে ফেলা হতে পারে, যদিও মোতাজ নুরের পরিচিত কেউ নন, তবুও তিনি এ খবর শুনে মোতাজের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করেছিলেন।
নুর বলেন, "তাদের সাংবাদিকতা শুধু সাংবাদিকতাই নয়। এটি একটি ডায়েরি। তারা আমাদেরকে তাদের জীবন দেখাচ্ছে। তারা আমাদের বলছে 'আমি এক সপ্তাহের জন্য গোসল করতে পারিনি।, আরে, আমি আজকে এখনও কিছু খাইনি।''
মোতাজ এর কয়েক ঘণ্টা পর মোতাজ আরো একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি জানান, তার বাড়িতে হামলা হয়নি। তবে অন্য জায়গার খবর ভাল নয়। একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা করেছে।
তার বেঁচে থাকার খবরে নুর যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের একটি জানালা ফিলিস্তিনিরা
ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলো তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মতো নুরও ফিলিস্তিনিদের চোখ দিয়ে গাজার যুদ্ধ দেখছেন। বিনিময়ে ব্যবহারকারীরা গাজার লোকদের মনোবল ধরে রাখতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।
লন্ডনের ক্রীড়া সাংবাদিক লায়লা হামেদ বলেছেন, তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো- ইনস্টাগ্রাম খুলে ফিলিস্তিনিদের প্রোফাইলে গিয়ে যুদ্ধ সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন পোস্ট দেখা। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ফিলিস্তিনিরা এসব খবরাখবর পোস্ট করছেন, লায়লা তাদের সহকর্মী হিসেবে মনে করেন।
লায়লা বলেন, "আমি তাদের জন্য এত বেশি সহানুভূতি বোধ করি যে আমি মাঝে মাঝে তাদের প্রোফাইল খুলতে ভয় পাই। শুধু মনে হয় তাদের সাথে হয়ত খারাপ কিছু ঘটেছে।"
টরন্টোর চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গল্পকার কানওয়াল আহমেদের রুটিনও লায়লার মতোই। তিনি বলেন, "তারা পুরো বিশ্বের পরিবার হয়ে উঠেছে।''
তিনি জানান, তাদের সাথে যুক্ত ফিলিস্তিনি কেউ যদি দীর্ঘ সময় কোনো পোস্ট না করেন, তাহলে তারা এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
ফিলিস্তিনি কনটেন্ট ক্রিয়েটর বিসান আওদার পোস্ট নিয়মিত অনুসরণ করেন কানওয়াল। তিনি বলেন, বিসান যদি ১২ ঘণ্টা কোনো পোস্ট না করে, তাহলে অনেকে টুইট করতে থাকেন, 'বিসান কোথায়', 'কেউ কি জানেন বিসান কোথায়'?, 'সে কি ঠিক আছে?' ইত্যাদি।
মোতাজ, আওদা ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিন্দ খুদারির মতো তরুণ ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বাড়ি ও সম্প্রদায় থেকে এসব খবর বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছে।
তাদের করা এসব পোস্ট থেকে গাজায় কী ঘটছে, যুদ্ধের কারণে সেখানকার মানবিক সংকটের কী পরিস্থিতি সে বিষয়ে অন্যরা জানতে পারছে। তাদের করা এসব পোস্টে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার এমনও কিছু ভয়ানক চিত্র রয়েছে যেগুলো সত্যিই মর্মান্তিক।
কানওয়াল বলেন, "প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব গল্প বলার সুযোগ পাচ্ছে। আপনি যখন কাউকে ধ্বংসস্তূপে বসে থাকতে দেখেন, কিংবা আপনি যদি দেখেন একটি পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে তার বাবার লাশের পাশে কাঁদছে তখন চোখ সরিয়ে নেওয়া সত্যিই কঠিন।''
তারা যুদ্ধকে দেখার উপায় বদলে দিচ্ছে
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের মতে, ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করার পর ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং জিম্মি হয় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ।
ইসরায়েল বলেছে, তাদের হামলার লক্ষ্য হলো সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল করা। তবে ইসরায়েলের এ হামলা গাজায় একটি মানবিক সংকট তৈরি করেছে, যা বিশ্বের মানুষ কাছ থেকে সেটি দেখতে পারছে।
ফিলিস্তিনিদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো গাজার ধ্বংসযজ্ঞ দেখা ও বোঝার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়গুলোর একটি। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্য করছে না।
গাজার বাইরে স্বাধীন সাংবাদিকতা খুবই কম। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া, তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা যেমন রয়টার্স এবং এএফপিসহ বেশিরভাগ সংবাদ সংস্থা সেভাবে গাজা যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারেনি। মিশরসহ ইসরায়েল মূলত এই অঞ্চল থেকে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের অবরুদ্ধ করেছে। গুটি কয়েক বিদেশী সাংবাদিককে প্রাথমিকভাবে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে সিএনএন এর সাংবাদিক ক্লারিসা ওয়ার্ড ও তার দল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ছাড়াই গাজায় প্রবেশের সুযোগ পান। গাজার অভ্যন্তরে একটি হাসপাতাল পরিচালনাকারী আমিরাতি সরকার তাদের এ সুযোগ প্রদান করেছিল।
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিক্স ফার্ম সোশ্যাল ব্লেড অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে ইনস্টাগ্রামে মোতাজের ফলোয়ার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ মিলিয়ন। বিসান আওদার ফলোয়ার ৩.৮ মিলিয়ন ও হিন্দ খোদারির ফলোয়ার সম্প্রতি এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) তথ্যমতে, গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত গাজা যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত ৮২ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭৫ জন ফিলিস্তিনি।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে কেউ কেউ এসব সাংবাদিকের প্রচেষ্টা বন্ধ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। ১০ জানুয়ারি ব্লগার ইসমাইল আল দাহদুহ তার ১.২ মিলিয়ন ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ারের কাছে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি তার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধের খবর আর প্রচার করবেন না।
অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা নিরাপত্তার আশঙ্কার পরও যুদ্ধের খবর প্রচার করে যাচ্ছেন।
আওদা ২ ডিসেম্বর একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখেছিলেন, 'গণহত্যা শুরুর আগে আমার যেভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিল, সেটি এখন আর নেই। আমি নিশ্চিত যে আগামী কয়েক সপ্তাহ কিংবা কয়েক দিনের মধ্যে মারা যাব।'
ওই দিনই মোতাজ একটি পোস্টে বলেন, 'কী ঘটছে তা বিশ্বকে দেখানোর জন্য আমার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার পর্যায়টি এখন শেষ। একটি নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে — বেঁচে থাকার পর্যায়।'