গত বছর শিশুরা ইউটিউবের চেয়ে টিকটকে ৬০% বেশি সময় কাটিয়েছে, ২০% চ্যাটজিপিটিতে
শিশুদের অনলাইন ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা ২০২৩ সালে টিকটকের শর্ট ভিডিও অ্যাপে প্রতিদিন গড়ে ১১২ মিনিট ব্যয় করেছে, যা আগের বছরে ছিল ১০৭ মিনিট।
যদিও ইউটিউব বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং অ্যাপ, তবে গত বছর শিশুরা ৬০% এর বেশি সময় টিকটকে কাটিয়েছে।
শিশুদের ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করা নিয়ে করা নতুন এই গবেষণায় ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটির মতো অভিনব প্রযুক্তির ব্যবহারও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
প্যারেন্ট কন্ট্রোল সফটওয়্যার নির্মাতা কুস্তোদিও থেকে নেওয়া বিশ্বব্যাপী ৪ লাখেরও বেশি পরিবার ও স্কুলের ডিজিটাল মিডিয়া অভ্যাস বিবেচনা করে এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির মোবাইল ও ডেস্কটপ ডিভাইসগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।
এই গবেষণার সবচেয়ে অনন্য দিক হলো এর তথ্য প্যানেলিস্ট প্রশ্নের পরিবর্তে বাস্তব পৃথিবীর শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে।
তবে, এই তথ্য সারা পৃথিবীর বাচ্চাদের ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারের অভ্যাসের ক্ষেত্রে পুরো সত্য নাও হতে পারে। কারণ এখানে শুধু সেসব বাড়ি ও স্কুলের বাচ্চাদের তথ্য রয়েছে, যারা তাদের ডিজিটাল ডিভাইসে প্যারেন্টিং কন্ট্রোল সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে।
তবুও, এটি থেকে সামগ্রিক প্রবণতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা গেছে।
উল্লেখ্য, সংস্থাটি এই বছর প্রথমবারের মতো শিশুদের এআইসহ অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে নজর দিয়েছে।
যেহেতু চ্যাটজিপিটি মে মাসের আগে আইওএসে এবং জুলাইয়ে অ্যান্ড্রয়েডে চালু হয়নি, তাই কুস্তোদিও কেবল ওপেনএআইয়ের ওয়েবসাইটের ব্যবহারে নজর দিয়েছে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০% শিশু গত বছর সাইটটি অ্যাক্সেস করেছে এবং এটি ওই বছরের ১৮ তম সর্বাধিক ভিজিট করা সাইটে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮.৭% বাচ্চারা সাইটটি ভিজিট করেছে এবং এটি সবমিলিয়ে ৩২ তম স্থানে ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার শিশুরা এই সাইট ভিজিটে সবচেয়ে এগিয়ে, কারণ ২০২৩ সালে দেশটির ২৪% শিশু সাইটটি ভিজিট করেছে।
এছাড়া, শিশুরা গত বছরের তুলনায় স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো দেখার জন্য ২৭% বেশি সময় ব্যয় করেছে।
যদিও কিছু পরিষেবার দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের ভিউয়ার সংখ্যায় প্রভাব পড়তে পারে।
সংস্থাটি দেখেছে, বাচ্চারা ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্স দেখার জন্য ৪% কম সময় ব্যয় করেছে, ডিজনি + এ দেখার জন্য ২৩% কম সময় এবং হুলুতে ১২% কম সময় ব্যয় করেছে।
এদিকে, ইউটিউব এবং এর সিস্টার অ্যাপ ইউটিউব কিডস রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাপী ইউটিউব কিডস দেখার সময় ১৪% বেড়েছে, অর্থাৎ, গড়ে প্রতিদিন ৯৬ মিনিটে পৌঁছেছে।
২০১৯ সালে তার ডেটা সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর থেকে এটি কুস্টোদিওর দেখা সর্বোচ্চ চিত্র।
অন্যদিকে, গড়ে ইউটিউব দেখার সময় ছিল ৭০ মিনিটে, যা গত বছর ছিল ৬৭ মিনিট।
যদিও নেটফ্লিক্স ২০২৩ সালে দাম বাড়িয়েছে এবং পাসওয়ার্ড নিয়ে বেশ কড়াকড়ি অবস্থানে ছিল, তবুও এটি বাচ্চাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় স্ট্রিমার হিসেবে আছে। ৪০% শিশু এই নেটফ্লিক্স ব্যবহার করেছে।
প্রথম স্থানে ছিল ইউটিউব, ৬৩% শিশু এটি ব্যবহার করেছিল এবং ডিজনি + ২০% নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল।
তবে, বছরের পর বছর জনপ্রিয়তা বাড়ানো একমাত্র পেইড সার্ভিস হলো নেটফ্লিক্স। কারণ ডিজনি +, অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও ও হুলুসহ অন্যান্য স্ট্রিমারদের ব্যবহার কমেছে।
পাশাপাশি, ২০২২সালে বাচ্চাদের লাইভস্ট্রিমিং পরিষেবা টুইচ ব্যবহারের হার ১১% থেকে ২০২৩ সালে মাত্র ৮% এ নেমেছে।
তবে, যারা এই বছর টুইচে রয়ে গেছেন তারা তাদের দেখার সময় বাড়িয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ২২ মিনিট অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী ১৬% বেশি সময় লাইভস্ট্রিম দেখেছেন তারা।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতি সম্পর্কে বাবা-মা এবং আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ সত্ত্বেও, বাচ্চাদের মধ্যে এসব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার ২০২৩ সালেও আগের মতোই জনপ্রিয় ছিল।
টিকটক বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক জনপ্রিয় অ্যাপ হিসেবে রয়ে গেছে, ৪৪% শিশু এটি ব্যবহার করে।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় অবস্থানে রয়েছে ফেসবুক, ৩৮% শিশু এটি ব্যবহার করে।
কুস্টোদিও বলেছে, ইলন মাস্কের টুইটারের রিব্র্যান্ডিংয়ের পর গত বছর ১৫ বছরের কম বয়সী ৩৮% শিশু প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছে, ২০২২ সালে যা ছিল ৩০%।
বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক অ্যাপ্লিকেশনগুলোর তালিকায় রেডিট, ইনস্টাগ্রাম ও পিন্টারেস্ট রয়েছে। যথাক্রমে ৩২%, ৩২% ও ৩১% শিশু এগুলো ব্যবহার করে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র কিছুটা আলাদা। সেখানে টিকটকের পরে এক্স, রেডডিট, ফেসবুক, পিন্টারেস্ট এবং তারপরে ইনস্টাগ্রাম রয়েছে।
অর্থাৎ, শিশুরা টিকটকে তার অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছে। বিশ্বব্যাপী শিশুরা টিকটকে গড়ে প্রতিদিন ১১২ মিনিট, ইনস্টাগ্রামে ৬৩ মিনিট, ফেসবুকে ১৯ মিনিট, পিন্টারেস্টে ১৬ মিনিট, এক্সে ১০ মিনিট এবং রেডডিটে ৯ মিনিট কাটিয়েছে।
মেটার হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, ৩৭% শিশু এটি ব্যবহার করে। এরপর স্ন্যাপচ্যাট (৩৫%), ডিসকর্ড (৩১%), ম্যাসেজ (২৮%), স্কাইপ (২১%) এবং গুগল ডুও (১৩%) ।
তবে, স্ন্যাপচ্যাট অ্যাপটিতে বাচ্চারা প্রতিদিন গড়ে ৭৪ মিনিট সময় ব্যয় করে, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসকর্ডে গড়ে ২৭ মিনিট ব্যয় করে।
গেমিং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে রবলক্স সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন গড়ে ১৩০ মিনিটের জন্য ৪৮% বাচ্চারা এটি ব্যবহার করে।
তারপরে রয়েছে মাইনক্রাফ্ট, অ্যামোং আস, ক্ল্যাশ রয়্যাল, স্টাম্বল গাইজ ও ম্যাজিক টাইলস ৩।
বাচ্চারা গত বছর গুগল ক্লাসরুমের মতো জনপ্রিয় লার্নিং অ্যাপ ব্যবহার অব্যাহত রেখেছিল। পাশাপাশি ডুয়োলিঙ্গো, ফটো ম্যাথ, কাহুট!, কুইজ লেট, সিম্পলি পিয়ানো ও ব্রেইনলির মতো শিক্ষামূলক অ্যাপগুলোও ব্যবহার করেছিল।
বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি, সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি কীভাবে মা-বাবাদের তাদের বাচ্চাদের প্রযুক্তি ব্যবহার পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করে।
কুস্তোদিও অভিভাবকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ২০২৩ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এআই টুলগুলো প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ হারে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও ছোট বাচ্চাদের (১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী) মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ বলেছেন তারা সক্রিয় ব্যবহারকারী।