এক খচ্চরপালকের জন্যই উদ্ধার পেয়েছিল আন্দিজ প্লেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা
একটি রাগবি দল, একটি ভয়ানক বিমান দুর্ঘটনা, মৃত সহযাত্রীদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকা এবং দেবদূতের মত একজন খচ্চরপালকের আগমন। এটি ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর আন্দিজ পর্বতমালায় বিধ্বস্ত হওয়া উরুগুয়ের বিমান বাহিনীর ফ্লাইট ৫৭১-এর গল্প। এ গল্প চিত্রায়িত করা হয়েছে জে. এ. বায়োনার সিনেমা 'সোস্যাইটি অভ দ্য স্নো'তে।
সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার একটি বিশাল অংশকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু বেঁচে থাকা ১৬ যাত্রীকে খুঁজে পেতে এবং উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সার্জিও কাতালানকে সিনেমায় ঠিকমতো কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি।
১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর একটি জুনিয়র রাগবি দল এবং তাদের পরিবার ও বন্ধুদের বহনকারী উরুগুয়ের বিমানবাহিনীর ফেয়ারচাইল্ড এফএইচ-২২৭ ডি উড়োজাহাজটি আন্দিজ পর্বতমালার মাঝখানে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে কারণে বিমানটির অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। শেষে চিলি ও আর্জেন্টিনার সীমান্তে, আন্দিজ পাহাড়ে আঘাত করেন।
সেদিন বিমানটিতে ৪০ জন যাত্রীসহ ৫ জন ক্রু সদস্য ছিল। তিনজন ক্রু ও আটজন যাত্রী তৎক্ষণাৎ ওই দুর্ঘটনায় মারা যান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২ হাজার ফুট ওপরে খাদ্যের অভাবে ও তীব্র শীতে আরও ১৮ জন মারা যান। ৭২ দিনের তীব্র ঠান্ডার মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুধু ১৬ জন বেঁচে ছিলেন।
এই বেঁচে থাকা ১৬ জনের মধ্যে দুইজনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় সার্জিও কাতালানের। তিনি সান্তিয়াগো ডি চিলির ১৪২ কিলোমিটার দক্ষিণে সান ফার্নান্দো শহরের পাহাড়ি এলাকাতে গবাদিপশু চড়াতেন এবং কৃষি কাজ করতেন। বেঁচে থাকা প্রত্যেককেই প্রতিকূল পরিবেশে অমানবিক কষ্ট করতে হয়েছিল। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণায় খেতে হয়েছিল নিজেদেরই মৃত সহযাত্রীর মাংস।
সার্জিও কাতালান বাস্তবে তাদের উদ্ধারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সিনেমাতে তাকে খুব অল্প সময়ের জন্যই দেখানো হয়েছে। বেঁচে থাকা সবার কাছে তিনি ছিলেন নায়ক, ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। এমনকি তাকে বাবা বলেও ডাকতেন উদ্ধার হওয়া সবাই। কাতালানের সাথে বেঁচে যাওয়া প্রত্যেকের সম্পর্ক টিকে ছিল দীর্ঘ পাঁচ যুগ, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
কে এই সার্জিও কাতালান?
সার্জিও হিলারিও কাতালান মার্টিনেজের জন্ম ১৯২৯ সালে কোলচাগুয়া প্রদেশের (বর্তমানে ও'হিগিনস অঞ্চল) ছোট গ্রাম পুয়েন্তে নেগ্রোতে। তিনি বিয়ে করেছিলেন ভার্জিনিয়া তোরোকে এবং তাদের নয়জন সন্তান ছিল। দুর্ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। তিনি তিনি পাহাড়ে পশু চালান করার কাজ করতেন।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে তিনি তাঁর ছেলে হুয়ান ডে লা ক্রুজের সাথে মেট্রোপলিটন অঞ্চলের দক্ষিণে বারোসো নদীর কাছে পশু চরাচ্ছিলেন। সেখানেই তার সাথে দেখা হয় রবার্তো ক্যানেসা এবং ফার্নান্দো নান্দো প্যারাডোর। দুজনেই উরুগুয়ের ওল্ড ক্রিশ্চিয়ান ক্লাবের রাগবি দলের সদস্য ছিলেন। বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৬ জনের দুজন ছিলেন তারা। আর্জেন্টিনার মেন্দোজা প্রদেশের পর্বতমালা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চিলির এই অংশে এসেছিলেন দুজনে সাহায্যের খোঁজে।
ক্যানেসা এবং প্যারাডোর সাথে প্রথম দেখা
কাতালান আর তার ছেলে যখন প্রথম এই দুজনকে দেখতে পান, ভেবেছিলেন তারা হয়তো শিকারি অথবা পর্যটক। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্যানেসা আর প্যারাড এতই ক্লান্ত ছিলেন যে তাদের কথা ঠিকমতো শুনতেই পাননি কাতালান। তবুও তিনি তাদের সাথে কথা বলার জন্য তাদের দিকে একটি কাগজের টুকরো ও পেন্সিল ছুড়ে দিয়েছিলেন।
বেঁচে যাওয়া ফার্নান্দো নান্দো প্যারাডো এবং রবার্তো ক্যানেসা সাহায্যের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। তারা একটি রেডিও ট্রান্সমিটারে শুনেছিলেন যে অনুসন্ধান অভিযান বাতিল করা হয়েছে। তাই নিজেরাই সাহায্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন।
সেই কাগজের টুকরোতে তাদের একজন লিখেছিলেন: 'আমি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হওয়া প্লেনের যাত্রী ছিলাম। আমি উরুগুয়ের নাগরিক। আমরা ১০ দিন ধরে হাঁটছি। আমার একজন বন্ধু সেখানে আহত অবস্থায় আছে। প্লেনটিতে ১৪ জন আহত ব্যক্তি আছে। আমাদের সেখান থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে। আমরা জানি না সেটা কীভাবে করব। আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই। আমরা ভীষণ দুর্বল হয়ে পরেছি। আমাদের খোঁজে কখন যাওয়া হবে? আমরা ঠিকমতো কথাও বলতে পারছি না। আমরা কোথায় আছি?'
কর্তৃপক্ষকে জানানো
কাতালান প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তার নিজের শহরের ক্যারাবিনেরোস চেকপয়েন্টে এসে ঘটনাটি পুলিশ ও দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জানান। শুরুতে তারা কাতালানের কথা বিশ্বাস করেননি, উল্টো তাকে মাতাল বলে প্রত্যাখান করেন। কিন্তু কাতালান যখন তাদেরকে কাগজের টুকরোটি দেখান, তারা অবাক হয়ে যায়।
ইএফই নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উদ্ধারকাজে যুক্ত হেলিকপ্টারগুলোর অন্যতম কোপাইলট র্যামন ক্যানালেস বলেছিলেন, 'উরুগুয়ের বিধ্বস্ত প্লেনটিতে আসলে কারও বেঁচে থাকার তথ্যটি আমাদের কাছে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।'
নিখোঁজ হওয়ার দুই মাসেরও বেশি সময় পরে চিলির উদ্ধারকারী দল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, দুর্ঘটনায় কেউ বেঁচে নেই। তাদের শুধু গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত, যাতে বরফ গলার পর মৃতদেহগুলোর সন্ধান করতে পারে।
ক্যানেসা ও প্যারাডোকে লস মাইতেনেস দে সান ফার্নান্দোর একটি র্যাঞ্চে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে চিলির টেলিভিশন তাদের সাক্ষাৎকার নেয়। দুই দিনের অভিযানের পর ১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বেঁচে থাকা সব যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়।
৫০ বছরের দীর্ঘ বন্ধুত্ব
রাগবি খেলোয়াড়দের কাছে ছিলেন সার্জিও কাতালান নায়ক। তাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, তা প্রায় পাঁচ দশক স্থায়ী হয়েছিল। বেঁচে যাওয়া সবার মুখেই ছিল তার নাম। চিলিতে গেলেই তারা কাতালানের সাথে দেখা করত। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ রবার্তো ক্যানেসা। পেশায় চিকিৎসক ক্যানেসা কাতালানের নিতম্বের অপারেশন করাতে সাহায্য করেছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯১ বছর বয়সে কাতালান মারা যান।
কাতালানের মৃত্যুর পর ক্যানেসা এল মারকিউরিও সংবাদপত্রকে বলেছিলেন, 'তার সম্পর্কে নতুন করে আপনাদেরকে আমি আর কী বলব? তিনি আমাদের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমরা আমাদের জীবনের জন্য এবং আমাদের যে ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি, আছে তাদের জন্য আমরা তার কাছে ঋণী।'
বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম গুস্তাভো জেরবিনো দলের বাকি সদস্যদের পক্ষে কাতালানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
জীবদ্দশায় চিলির এই নাগরিক বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০১১ সালে সান ফার্নান্দোর মিউনিসিপ্যালিটি মনুমেন্টো আল অ্যারিয়েরো উদ্বোধন করে। ভাস্কর্যটি কাতালানসহ পশুপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের সম্মানে তৈরি করা হয়েছিল। উরুগুয়ের রাজধানী মন্টিভিডিওতে অবস্থিত আন্দিজ ১৯৭২ জাদুঘরেও চিলির এই কিংবদন্তির একটি ভাস্কর্য রয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়