“মৃত সহযাত্রীর মাংস খেয়ে বেঁচে ফেরা”: আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনার ৫১ বছর
১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর একটি জুনিয়র রাগবি দল ও তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের বহনকারী উরুগুয়ের বিমান বাহিনীর একটি বিমান আন্দিজ পর্বতমালার মাঝখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল। পাইলট প্রতিকুল আবাহাওয়ায় ঠিকমত দেখতে না পারার কারনে বিমানটির অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন তিনি সান্তিয়াগোতে অবতরণের জন্য নামছিলেন। কিন্তু তিনি আসলে চিলি এবং আর্জেন্টিনার সীমান্তে আন্দিজ পাহাড়ে আঘাত করেছিলেন।
বিমানটির নাম ছিল ফেয়ারচাইল্ড এফএইচ-২২৭ ডি যেটি আমেরিকায় তৈরি করা হয়েছিল এবং ৫০ জন যাত্রী বহন করতে পারতো। সেদিন বিমানটিতে ৪০ জন যাত্রী সহ ৫ জন ক্রু সদস্য ছিল। ৭২ দিনের তীব্র ঠাণ্ডার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ১৬ জন শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যেই অসিম যন্ত্রণা তারা ভোগ করেছিলেন তা পরবর্তীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ২৬ টি বই, ৯ টি তথ্যচিত্র এবং ৪ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাতে।
কার্লোস পায়েজ ছিলেন এই বেঁচে যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে একজন। ৬৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি এখন একজন পিতা এবং কৃষি প্রযুক্তিবিদ।
এল পেইস সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে একটি ভিডিও কলে তিনি বলেন, "সেই সময়ে আমরা হলিউডে যাওয়ার কথা কিংবা ৫০ বছর পর সাক্ষ্যাতকার দেওয়ার কথা ভাবিনি। আমি লড়াই করে যাচ্ছিলাম বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। আমার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য।"
তিনি এই ঘটনা স্মরণ করে বলেন, "আমার বয়স তখন ছিল ১৮ বছর। আমার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যিনি আমাদের সবকিছুই দিয়েছিলেন। আমার একজন পরিচারিকা ছিলেন যিনি আমার সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কখনো শীতে ভুগিনি অথবা ক্ষুধার জ্বালা টের পাইনি। আমি আসলে কখনোই গুরুত্বপূর্ন কিছু করিনি। তারপরও আমি সবচেয়ে অবিশ্বাস্য এক বেঁচে যাওয়া গল্পের অংশ ছিলাম।"
বিমানটি আর্জেন্টিনার পশ্চিমে এবং চিলির সান্তিয়াগোর চূড়ান্ত গন্তব্য থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বিমানটি ডানা এবং লেজ হারিয়ে পাহাড়ে দুবার আঘাত করেছিল। তিনজন ক্রু ও আটজন যাত্রী তৎক্ষণাৎ এই দূর্ঘটনায় মারা যান।
দুর্ঘটনার আট দিন পরে বরফের মধ্যে সাদা বিমানটি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়ায় অনুসন্ধান অভিযান বাতিল করা হয়েছিল। এবং গ্রীষ্মের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২ হাজার ফুট উপরে, খাদ্যের অভাব এবং তীব্র শীতের মুখোমুখি হয়ে, উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা আরো ১৮ জন মারা যান।
১৯৯৩ সালের সিনেমা "অ্যালাইভ" এই ট্র্যাজেডি নিয়ে নির্মিত সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। বরফের মধ্যে দিন কাটানো পায়েজের সঠিক উপস্থাপন এই সিনেমাতে করা হয়েছিল। অভিনেতা জন মালকোভিচ প্রাপ্তবয়স্ক পায়েজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাতে তিনি সেই ট্র্যাজেডির বর্ণনা দিয়েছেন যেটি পায়েজের জীবনকে বদলে দিয়েছে যখন তিনি কিশোর ছিলেন। সিনেমার চূড়ান্ত দৃশ্যে দুটি হেলিকপ্টার বিমানটির ধ্বংসস্তুপের কাছে পৌছায় যেখানে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে মালকোভিচ বর্ণনা দিয়েছিলেন, "নান্দো এবং ক্যানেসা আন্দিজ পার হয়ে আমাদের বাঁচিয়েছিল। এর থেকে বেশি কিছু আমি আপনাদের বলতে পারবো না।"
বেঁচে যাওয়া ফার্নান্দো নান্দো প্যারাডো এবং রবার্তো ক্যানেসা সাহায্যের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। তারা একটি রেডিও ট্রান্সমিটারে শুনেছিলেন যে অনুসন্ধান অভিযান বাতিল করা হয়েছে। তাই নিজেরাই সাহায্য খোঁজার চেষ্টা করেন।
ক্যানেসা যিনি এখন একজন বিখ্যাত ডাক্তার, এই ঘটনা স্মরন করে বলেন, "যখন আপনি শুনতে পান যে তারা আপনাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছে এবং পৃথিবী আপনাকে ছাড়াই চলছে...আপনার উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নাকি নিজ থেকেই বাঁচার চেষ্টা করা উচিত এই নিয়ে দ্বিধা দূর হয়ে যায়।"
তিনি আরও বলেন, "আমি ধ্বংসাবশেষ ছেড়েছি কারণ আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম। আমার মনে আছে যে আর্তুরো নোগুইরা যিনি শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিলেন, আমাকে বলেছিলেন, 'আপনি কত ভাগ্যবান, আপনার সুস্থ পা আছে এবং আপনি হাঁটতে পারেন এবং অন্যদের বাঁচাতে পারেন।' এটি আমাকে সাহস যুগিয়েছিল সম্ভবত।"
দুর্ঘটনার ঠিক দুই মাস পরে ১২ ডিসেম্বর ক্যানেসা এবং প্যারাডো পশ্চিমে পাহাড়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু নিকটতম শহরটি ৫০ মাইলেরও কম দূরে ছিল কিন্তু তারা এটি জানত না। হাঁটতে হাঁটতে নবম দিনে তারা কয়েকটি গরু দেখতে পেল। রাতে দূর থেকে গরুগুলোর মালিককে তারা দেখতে পান। মালিকের নাম ছিল সার্জিও কাতালান এবং তিনি চিলির খচ্চর চালক ছিলেন।
ক্যানেসা বলেন, "তিনি আমাদের আগে দেখেছিলেন এবং ভেবেছিলেন আমরা শিকার করছিলাম। আমরা ট্রেকিংয়ের খুঁটি নিয়ে যাচ্ছিলাম যেগুলোকে সে শটগান ভেবেছিল। আমরা তাঁকে দেখে চিৎকার করেছিলাম কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারেনি।" ক্যানেসা এবং প্যারাডো লোকটির থেকে অনেক দূরে ছিল। তারা একটি নোট লিখে পাথরের সাথে বেঁধে সেটি কাতালানের দিকে ছুড়ে দেয়।
"তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'আগামীকাল! আগামীকাল!'", হাসতে হাসতে বলছিলো ক্যানেসা। "এটি ছিল আমাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর সকাল।"
অবশেষে ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার পর বেঁচে থাকা দলটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। কথা বলার জন্য, বই লেখার জন্য এবং ম্যাগাজিনের কভারে ছবি দেওয়ার জন্য জন্য তারা অফুরন্ত আমন্ত্রণ পেতে থাকে।
পায়েজ এই ঘটনাকে স্মরণ করে বলেন, "১৮ বছর বয়সে বিখ্যাত হওয়া খুব মজার।"
কিন্তু খ্যাতির সাথে তারা বড় ধাক্কাও খায়। উরুগুয়েতে ফিরে আসার সাথে সাথে মন্টেভিডিওতে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে যে বেঁচে থাকা লোকেরা যখন খাবার ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছিল তখন দলের কিছু সদস্যকে হত্যা করেছিল। কেউ কেউ এই আক্রমনাত্মক আলাপগুলো মোকাবেলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অন্যরা যেমন পায়েজ এবং ক্যানেসা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, সবচেয়ে ভালো জিনিস হল এই নিয়ে কথা বলা।
পায়েজ ১৯৭৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, "এই ধরণের আলাপ আমাদের বিরক্ত করেছিল কারণ এটি সত্য ছিল না। এটি মারা যাওয়া ছেলেদের পরিবারের মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল। কিছু পত্রিকা বলেছিল যে, আমরা নরখাদক ছিলাম। এটি সত্য নয় কারণ নরখাদক হওয়া মানে অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করা এবং আপনি মানুষের মাংস খেতে পছন্দ করেন। আমরা তা করিনি।"
এই ট্র্যাজেডির অর্ধ শতাব্দী পরেও দুজনেই এখনও খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেন, বেশ কয়েক দিন পরে তারা মারা যাওয়া সহযাত্রীর কিছু অবশিষ্টাংশ খেয়েছিলেন।
পায়েজ বলেন, "বন্ধুর কিছু অংশ শরীর ও আত্মায় বহন করা সম্মানের তখনই যখন সে বন্ধু মরে যেয়েও অন্য বন্ধুদের বাঁচতে সাহায্য করে।"
তিনি আরো বলেন, "আমি সাধারণত অন্যদের উল্টো প্রশ্ন করি: আপনি কি একই কাজ করতেন না? আপনি যখন ১০ দিন না খেয়ে থাকেন তখন অসম্ভব কাজও সহজ হয়ে যায়।"