প্রথমবারের মতো ডারউইনের হারিয়ে যাওয়া লাইব্রেরি উন্মুক্ত করল গবেষকরা
১৮৮২ সালে তার মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো, চার্লস ডারউইনের লাইব্রেরিটি পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
বিখ্যাত এই প্রকৃতিবিদের সংগৃহীত প্রচুর বই, পাম্পলেট ও জার্নাল পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে ভার্চুয়ালি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
অসংখ্য বইয়ের লেখক ডারউইন সম্ভবত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত 'অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস' বইয়ের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
'ডারউইন অনলাইন প্রজেক্ট' নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় একদল গবেষক। তারা ১২ ফেব্রুয়ারি ডারউইনের ২১৫ তম জন্মদিনের সম্মানে একটি ৩০০ পৃষ্ঠার ক্যাটালগ প্রকাশ করেছে।
এতে ডারউইনের মালিকানাধীন ৭৪০০ বইয়ের নাম ও ১৩ হাজার বইয়ের খণ্ড রয়েছে।
ক্যাটালগটিতে লাইব্রেরির বিষয়বস্তুর অনুলিপিগুলোর ৯৩০০টি লিংক রয়েছে, যা বিনামূল্যে অনলাইনে পাওয়া যাবে।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে ডারউইন কী কী বই পড়েছেন তা পড়ার জন্য পাঠকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এই প্রকল্পের নেতা ড. জন ভ্যান ওয়াইহে বলেছেন, 'ডারউইনের সম্পূর্ণ গ্রন্থাগারের এই উপস্থাপন আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে তিনি বিচ্ছিন্ন কোনো মানুষ ছিলেন না। বরং হাজার হাজার লোকের পরিশীলিত বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং অন্যান্য জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তার সময়ের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে, এই লাইব্রেরির কাজের আকার ও পরিসর অন্যদের কাজ সম্পর্কে ডারউইনের গবেষণার অসাধারণ ব্যাপ্তি প্রকাশ করে।'
হারিয়ে যাওয়া লাইব্রেরি এক জায়গায় আনা
ডারউইনের জীবদ্দশায় তিনি তার লাইব্রেরির সব নথিপত্র সংরক্ষণ করতেন।
যার মধ্যে ১৮৭৫ সালে সংকলিত ৪২৬ পৃষ্ঠার হাতে লেখা 'ক্যাটালগ অব দ্য লাইব্রেরি অব চার্লস ডারউইন'ও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ডারউইনের মৃত্যুর পর তার গ্রন্থাগারটি সংরক্ষণ ও রেকর্ড করা হয়।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর বেশিরভাগ সামগ্রী হারিয়ে গেছে বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।
১৪৮০ টি বইয়ের দুটি প্রধান সংগ্রহ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাউন হাউসে রাখা হয়েছিল। ডারউইনের পারিবারিক বাড়ি ডাউন হাউস ইংল্যান্ডে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
তবে সংগ্রহগুলোতে মূল গ্রন্থাগারের আনুমানিক ১৫% বই ছিল।
ডারউইনের লাইব্রেরি থেকে নির্দিষ্ট শিরোনাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে গবেষক ও জনসাধারণের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পরে, ভ্যান ওয়াইহে এবং তার সহকর্মীরা ২০০৭ সালে ভার্চুয়ালি ডারউইনের সংগ্রহ সংকলনের প্রকল্প হাতে নেন।
ভ্যান ওয়াইহে বলেন, 'বিশেষজ্ঞরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ডারউইনের জীবন ও কাজ নিয়ে গবেষণা করছেন।'
তিনি বলেন, 'ডারউইনের তত্ত্বগুলো বোঝার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হলো তার উৎসগুলো। অর্থাৎ, অন্যদের প্রকাশিত প্রকাশনা, যা তিনি তার গবেষণায় ব্যবহার করেছিলেন।'
ডাউন হাউস মিউজিয়াম, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ও ক্রাইস্ট কলেজ কেমব্রিজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অন্যান্যদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ১৮ বছর ধরে এই বইগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।
তার সুশৃঙ্খল রেকর্ডকিপিং সত্ত্বেও, ডারউইন তার সংগ্রহে জার্নাল ও পুস্তিকাগুলো উল্লেখ করার জন্য সংক্ষিপ্ত বা অস্পষ্ট উপায় ব্যবহার করেছিলেন। তাই অনেক বইয়ের এট্রির লেখক, তারিখ বা উৎস অনুপস্থিত।
দলটি তাদের অনুসন্ধান কাজের সময় উপস্থিত প্রতিটি কাগজের টুকরো জোড়া দিয়ে, হাতে লেখা পারিবারিক নথি ও চিঠি, ডারউইনের পড়ার নোটবুক, তার স্ত্রীর ডায়েরি এবং এক শতাব্দী আগে লিখিত পণ্ডিতদের তালিকা ঘেঁটে দেখে।
সব নথি তুলনা করে, গবেষকরা বাঁধাই করা বই এবং আনবাউন্ড ভলিউম ও প্যামফলেটসহ হাজার হাজার আগে অজানা শিরোনাম খুঁজে পেয়েছেন এবং গত ১০০ বছরে নিলামে বিক্রি হওয়া শিরোনামগুলোর সন্ধান করেছেন।
ভ্যান ওয়াইহে বলেন, 'এটা পাঁচ হাজার ছোট গোয়েন্দা গল্পের মতো। ডারউইন কোন লেখক বা নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তিনি যে-সব উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন, তা খুঁজে বের করাও আনন্দের।'
একটি বিস্ময়কর সংগ্রহ
স্বাভাবিকভাবেই ডারউইনের ক্যাটালগে জীববিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ব বিষয়ক প্রচুর বইয়ের শিরোনাম ছিল। তার কাছে পক্ষীবিদ জন জেমস অডুবন রচিত একটি নিবন্ধের অনুলিপি ছিল, এর নাম 'টার্কি বাজার্ড'।
১৮৩১ সালে তিনি প্রকৃতিবিদ হিসেবে জাহাজে আরোহণ করেন এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও গালাপাগোসসহ আশেপাশের দ্বীপগুলোতে উদ্ভিদ ও প্রাণী অধ্যয়ন ও সংগ্রহের জন্য ভ্রমণ করেন।
তিনি 'এক্সপ্লোরেশনস অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চারস ইন ইকুয়াটোরিয়াল আফ্রিকা'-এর একটি অনুলিপিরও মালিক ছিলেন।
এটা ১৮৫০ এর দশকে আফ্রিকায় অভিযানের সময় বন্য গরিলাদের বর্ণনা দেওয়া প্রথম ইউরোপীয় প্রাণিবিদ পল ডু চাইলের লেখা। ডারউইনের সংগ্রহে একটি জার্মান সাময়িকীও ছিল, যা ১৮৭৭ সালে ব্যাকটেরিয়ার প্রথম ছবি প্রকাশ করেছিল।
ভ্যান ওয়াইহে বলেন, 'এই প্রকৃতিবিদের লাইব্রেরিতে অসংখ্য লেখকের বই ছিল। জ্ঞানের প্রতি তার তৃষ্ণা কত তীব্র ছিল এতে তা প্রকাশ পায়। ডারউইন জন স্টুয়ার্ট মিল ও অগাস্ট কোঁতের মতো দার্শনিকদের বইও পড়েছিলেন। এছাড়া মনোবিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্প, ইতিহাস, ভ্রমণ, কৃষিকাজ ও পশু প্রজনন এবং আচরণ সম্পর্কেও বেশ কয়েকটি বই পড়েছিলেন।
এগুলোর প্রায় অর্ধেক বই ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, ড্যানিশ, ল্যাটিন, স্প্যানিশ এবং সুইডিশ ভাষায় লেখা।
ভ্যান ওয়াইহে বলেন, 'তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তিনি স্কুলে প্রাচীন গ্রিক, ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন।'
তিনি বলেন, 'পরে তিনি বিগলের সমুদ্রযাত্রার জন্য স্প্যানিশ ও কিছুটা পর্তুগিজও শিখেছিলেন। এমনকি নিজে নিজে জার্মান ও ইতালিয়ান পড়তে শিখেছিলেন। এছাড়া, তিনি অন্যান্য অনেক ভাষা বুঝতেন। এ থেকে বোঝা যায়, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা কী ভাবছেন তা জানার জন্য এবং তার তত্ত্বের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য বের করতে তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।'
ডারউইন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যবহৃত অঙ্গভঙ্গি বোঝার জন্য অভিযাত্রী ও মিশনারিদের ভ্রমণকাহিনি পড়েছিলেন বলেও প্রমাণ রয়েছে।
ডারউইন উপন্যাস পড়তেও ভালোবাসতেন।
১৮৬৬ সালে এলিজাবেথ গ্যাসকেল এর লেখা উপন্যাস 'ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস' প্রকাশ হয়। ২০১৯ সালে ডারউইনের সংগ্রহে থাকা এর একটি অনুলিপি নিলামে উঠেছিল। এতে লেখা ছিল, 'এই বইটি চার্লস ডারউইনের অত্যন্ত প্রিয় একটি বই।'
ভ্যান ওয়াইহে বলেন, ডারউইনের সারগ্রাহী লাইব্রেরিটি তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রকাশ করে। মানুষকে বুঝতে সাহায্য করবে ডারউইন মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন।
তিনি বলেন, এতে বোঝা যায়, তিনি একজন উৎসাহী পাঠক ছিলেন এবং তিনি বিস্ময়কর সংখ্যক বই পড়েছিলেন।