‘আমরা জানতাম না আমাদের যুদ্ধে পাঠানো হবে’: রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া ভারতীয় ও নেপালিরা
ভালো জীবিকার তাগিদে ভারত ছেড়ে গত বছরের ডিসেম্বরে রাশিয়াতে পাড়ি দিয়েছিলেন গুজরাটের এক ছোট গ্রামের যুবক হেমিল মাঙ্গুকিয়া। ইউটিউবে চাকরির এক ভিডিও দেখে ২৩ বছর বয়সী হেমিল সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতে রাশিয়া যান। কিন্তু রাশিয়ায় যাওয়ার কিছুদিন পরে বাসায় ফোন দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, তাকে এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়েছে। তারপর তাকে সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হয় যেখানে তাকে পরিখা খনন করার পাশাপাশি অস্ত্র পরিবহণ এবং অস্ত্র চালানোর কাজ করতে হয়েছে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে হেমিলের সাথে তার পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর আসে সেই অপ্রত্যাশিত ফোন যেখানে তার ৫২ বছর বয়সী বাবা অশ্বিন মাঙ্গুকিয়াকে জানানো হয়, হেমিল ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের কোন এক স্থানে নিহত হয়েছেন।
অশ্বিন মাঙ্গুকিয়া জানিয়েছেন, "সে হয়ত আমাদের কাছ থেকে নিজের বিপদের কথা গোপন করেছিল। এই ঘটনাতে আমার পুরো পরিবার শোকে বিহ্বল হয়ে পরেছে। আমরা এখনো ওর লাশ ফেরত পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।"
হেমিল মাঙ্গুকিয়ার এই মৃত্যুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া আরো ভারতীয়দের নাম উঠে এসেছে যাদেরকে প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনীকে সহায়তাকারী অথবা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির কথা বলে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কয়েকজনের পরিবারের ভাষ্যমতে, অনেকেরই দুবাইয়ে চাকরির জন্য যাওয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, ভারতের পাঞ্জাব থেকে রাশিয়ায় ঘুরতে যাওয়া সাতজনকে একজন এজেন্ট বেলারুশে নিয়ে যান ও আটক করেন। ভিডিওতে গঙ্গাদ্বীপ সিং নামে আটকদের মধ্যে একজন বলেছেন, তাদেরকে রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য জোর করা হচ্ছে।
বুধবার (৬ মার্চ) মোহাম্মদ আফসান নামে আরেকজন ভারতীয় সম্মুখযুদ্ধে নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনিও গত বছরের নভেম্বরে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির জন্য মস্কো গিয়েছিলেন। নিহতের ভাই জানিয়েছেন, আফসানের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না।
নেপালে এই সমস্যা আরো তীব্র হওয়ায় নেপাল সরকার রাশিয়া ও ইউক্রেনে কাজ করার জন্য নাগরিকদের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ধারণা করা হয়, হাজারের উপরে নেপালী নাগরিক রুশ বাহিনীর হয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের ইচ্ছাতে গেলেও অন্যরা জানিয়েছেন, তারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে গিয়েছেন।
ভারতীয় এবং নেপালিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়াতে পৌঁছানোর পর তাদেরকে জোর করে রুশ ভাষায় লেখা চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করানো হয়েছে এবং তাদের পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীরতে তারা জানতে পারেন তাদেরকে এক বছর বাধ্যতামূলকভাবে রুশ সেনা বাহিনীতে যোগ দিতে হবে এবং এটি না করলে জেলে যেতে হবে। তারপর দুই সপ্তাহের কম সময়ের প্রস্তুতিতে তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য ইউক্রেনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের কাশ্মীরের ৩১ বছর বয়সী আজাদ ইউসুফ কুমার গত বছরের ডিসেম্বরে দুবাইতে গৃহকর্মীর চাকরি নিয়েছিলেন। ইউটিউব থেকে পরিচিত হওয়া এক দালালকে তিনি অগ্রিম ৩ লাখ রুপি দিয়েছিলেন এই চাকরির জন্য। কিন্তু তার পরিবারের ভাষ্যমতে, দুবাইয়ের পরিবর্তে তাকে রাশিয়াতে পাঠানো হয়েছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণ চলাকালীন তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং তারপর তাকে ইউক্রেনে একটি রুশ সৈন্যদলের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়।
ইউসুফ কুমার তার পরিবারকে জানিয়েছেন, তার মত সৈন্যদলটির আরো অনেককেই ভারত এবং নেপাল থেকে এনে জোর করে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে।
ভারতের অনেকেই জানিয়েছেন, ফয়সাল খান নামে একজন ভারতীয় বাবা ব্লগস নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে তার ৩ লাখ ফলোয়ারের উদ্দেশ্যে একাধিক ভিডিও পোস্ট করেছেন যেখানে তিনি নিজেই সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাশিয়ায় সামরিক বাহিনীর সহায়তাকারীর চাকরির কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, এই চাকরি অনেক নিরাপদ ও তাদেরকে সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হবে না এবং এর মাধ্যমে তারা রুশ নাগরিকত্বও পাবে।
ফয়সাল খান দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, তিনি ২৬ জন ভারতীয়কে রাশিয়া পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছেন, একজন রুশ মধ্যস্ততাকারী তাকে চাকরির ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়েছেন এবং তিনি জানতেন না এই ভারতীয়দের সম্মুখযুদ্ধে পাঠানো হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন, তিনি এখন এই ভারতীয়দের সেখান থেকে ফেরত আনার চেষ্টা করছেন।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুবাদক হিসাবে কর্মরত একজন ভারতীয় ব্যক্তি (যিনি বিদেশি যোদ্ধাদের নিয়োগ করেন) মস্কো থেকে একটি পোস্টে জানিয়েছেন, ভারত ও নেপাল থেকে যারা এসেছেন তাদের অনেকেরই ধারণা ছিল না যে তাদেরকে যুদ্ধে পাঠানো হবে।
রাশিয়ার সাথে ভারত সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি ভারত সরকার স্বীকার করেছে, ২০ জনের মত ভারতীয় রুশ বাহিনীতে নিযুক্ত আছেন এবং সরকার তাদেরকে দ্রুত দেশে ফেরত আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অমৃত বাহাদুর রায় বলেছেন, তারাও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তারা রাশিয়ায় থাকা তাদের নাগরিকদের সঠিক সংখ্যা জানেন না।
অমৃত বাহাদুর রায় আরো বলেছেন, ২৪৫টি পরিবার পিটিশন দাখিল করেছে। তারা দাবি করেছেন, তাদের আত্মীয়রা রুশ সেনাবাহিনীতে আটকা পড়েছে। আরো পাঁচজনকে ইউক্রেন যুদ্ধবন্দি হিসেবে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়