ভারতে জাতীয় নির্বাচনের আগে এআই নিয়ন্ত্রণে তৎপর মোদি সরকার
ভারতে থাকা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে 'অনির্ভরযোগ্য' বা 'পরীক্ষাধীন' জেনারেটিভ এআই মডেল বা টুল বাজারে আনার আগে অনুমোদন নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (এমইআইটিওয়াই)।
আসন্ন নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সংস্থাগুলোকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, তাদের এআই প্রোডাক্ট এমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা উচিত না, যা দেশের 'নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়'।
এআই নিয়ন্ত্রণের এই উদ্যোগে, ভারত সরকারের আগের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে তারা সংসদে জানায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে না তারা।
তবে, গত সপ্তাহে গুগলের এআই জেমিনি 'মোদি কী ফ্যাসিস্ট'- এই প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক উত্তর দেওয়াকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়।
এরপরই ভারতের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (এমইআইটিওয়াই) এই নির্দেশনা জারি করে।
ওই প্রশ্নের জবাবে জেমিনি জানায়, 'নরেন্দ্র মোদি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা। তার বিরুদ্ধে এমন নীতি বাস্তবায়নের অভিযোগ তোলা হয়েছে যেগুলোর কারণে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তাকে ফ্যাসিবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন।'
কীসের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা এমন বলছেন? তার জবাবে জেমিনির বক্তব্য, 'বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ, ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসামূলক আচরণসহ বেশ কয়েকটি কারণের উপর দাঁড়িয়েই এই অভিযোগ করা হচ্ছে।'
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর গুগলের জেমিনির বিরুদ্ধে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।
চন্দ্রশেখর দাবি করেছেন, গুগল এই জবাবের জন্য ক্ষমা চেয়েছে এবং বলেছে যে এটি একটি 'অনির্ভরযোগ্য' অ্যালগরিদমের ফলাফল।
সংস্থাটি বলেছে, তারা সমস্যার সমাধান করছে এবং সিস্টেমটি আরও উন্নত করতে কাজ করছে।
পাশ্চাত্যে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়ই উদারপন্থি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে।
পক্ষপাতিত্বের এই অভিযোগগুলো ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি এবং মাইক্রোসফ্ট কোপাইলটসহ জেনারেটিভ এআই প্রোডাক্টগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে, ভারতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে এআই উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
তাদের আশঙ্কা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের ফলে সদ্য বিকশিত এই শিল্পের প্রসার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অন্যরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কারণ শিগগিরই জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই নির্দেশনার ফলে মোদি সরকারের কোন এআই অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে অনুমোদন দেবে এবং কোনগুলোকে নিষিদ্ধ করবে তা বেছে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করতে পারে।
'লাইসেন্স রাজের অনুভূতি'
ভারতের সফটওয়্যার ফ্রিডম ল সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মিশি চৌধুরী বলেন, 'এই প্রবিধান নীতিনির্ধারণের চেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক অবস্থান বলেই মনে হচ্ছে।'
বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক এআই সলিউশন সংস্থা সেন্ট্রা ওয়ার্ল্ডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হর্ষ চৌধুরী বলেছেন, 'সরকারের এই বাধ্যবাধকতা আরোপের ফলে বিকাশমান এই শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষত স্টার্টআপগুলোর।'
তিনি বলেন, 'যদি প্রতিটি এআই পণ্যের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, তবে এটি সরকারের জন্যও একটি অসম্ভব কাজ হয়ে যাবে বলে মনে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এই মডেলগুলো পরীক্ষা করার জন্য তাদের অন্য জেনারাই (জেনারেটিভ এআই) বটের প্রয়োজন হতে পারে।'
জেনারেটিভ এআই শিল্পের আরও বেশ কয়েকজন নেতাও এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের সমালোচনা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আন্দ্রেসেন হরোউইটজের জেনারেল পার্টনার মার্টিন কাসাদো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ লিখেছেন, এটি একটি 'প্রহসনমূলক', 'উদ্ভাবন-বিরোধী' ও 'জনবিরোধী' পদক্ষেপ।
অ্যাবাকাস এআইয়ের সিইও বিন্দু রেড্ডি লিখেছেন, 'নতুন নির্দেশনার মাধ্যমে ভারত তার ভবিষ্যতকে বিদায় জানাল!'
মন্ত্রী চন্দ্রশেখর তার এক্সে (পূর্বে টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে ব্যাখ্যা করেছেন, 'ভারতীয় ইন্টারনেট'- এ জেনারেটিভ এআই প্রোডাক্ট স্থাপনে স্টার্ট-আপগুলোর আগাম অনুমতি নেওয়ার বিষয়টিকে ছাড় দেবে সরকার এবং নির্দেশনাটি শুধু 'জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর' ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কিন্তু অনিশ্চয়তার মেঘ রয়েই গেছে।
মিশি চৌধুরী বলেন, 'নির্দেশনাটি 'অনির্ভরযোগ্য', 'অপরীক্ষিত' এবং 'ভারতীয় ইন্টারনেট'-এর মতো অস্পষ্ট শব্দে পূর্ণ। এর ব্যাপ্তি, প্রয়োগ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল।'
তিনি আরও বলেন, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত প্রচলিত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারি অনুমতির বাধ্যবাধকতার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটি ৮০ দশকের লাইসেন্স রাজের অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনছে।'
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজনীয়তার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন, যার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এছাড়া, কেবল হ্যান্ডপিক করা স্টার্ট-আপগুলোর জন্য নির্দেশনা থেকে ছাড় দেওয়াটা, তাদের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও বিভ্রম তৈরির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
মিশি বলেন, তাই এই ছাড় 'উত্তর দেওয়ার চেয়ে আরও বেশি প্রশ্ন তৈরি করছে'।
হর্ষ চৌধুরী বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে এই নির্দেশনার পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, যারা নেতিবাচক এআই প্রোডাক্ট উদ্ভাবন করছে, সেসব সংস্থাকে জবাবদিহি করা।
তিনি আরও বলেন, 'তবে আগে অনুমতি নেওয়া, এর সবচেয়ে ভালো বিকল্প নাও হতে পারে।'
ডিপফেকের ছায়া
প্রযুক্তি নীতি থিংক ট্যাংক দ্য ডায়ালগের প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শ্রুতি শ্রেয়া বলেন, এআই কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে ভারতের পদক্ষেপের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবও থাকবে।
তিনি বলেন, 'দ্রুত বর্ধনশীল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনসংখ্যার দেশ ভারতের এই নীতিগুলো অন্যান্য দেশগুলোতে, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বে কীভাবে এআই কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা করবে তার একটি নজির স্থাপন করতে পারে।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সরকারের জন্য এআই নীতিমালা মোকাবিলা করা একটি কঠিন ভারসাম্য রক্ষার কাজ।
আগামী এপ্রিল ও মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক ভোট দেওয়ার কথা।
সহজলভ্য ও প্রায় বিনামূল্যে জেনারেটিভ এআই সরঞ্জামগুলোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ইতোমধ্যে ম্যানিপুলেটেড মিডিয়ার জন্য একটি উন্মুক্ত ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় এটি নির্বাচনের সত্যতার ওপরও ছায়া ফেলেছে।
ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারণায় ডিপফেক ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে।
দ্য ডায়ালগ থিংক ট্যাংকের ডেটা গভর্নেন্স এবং এআই বিষয়ক সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামেশ শেখর বলেছেন, সাম্প্রতিক অ্যাডভাইজরিটিকে জেনারেটিভ এআই নীতিমালার খসড়া করার জন্য সরকারের চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেও ভাবা উচিত।
এর আগে, ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে, ভারত সরকার বিগ টেক সংস্থাগুলোকে অভিযোগ করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিপ ফেক আইটেমগুলো তুলে নিতে, ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া চিহ্নিত করতে এবং ভুল তথ্য মোকাবিলায় প্রচেষ্টা বাড়াতে বলেছিল। তবে এই নির্দেশনা না মানলে কোনো সুস্পষ্ট জরিমানার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
শেখর বলেন, এই নির্দেশনায় কোনো প্রোডাক্ট উন্মোচনের আগে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এর ফলে উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, 'সরকার একটি স্যান্ডবক্স গঠনের কথা বিবেচনা করতে পারে। যেমন: একটি লাইভ-টেস্টিং পরিবেশ, যেখানে এআই বিশেষজ্ঞ এবং অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলো প্রোডাক্টের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য বড় আকারের রোলআউট ছাড়াই পণ্যটি পরীক্ষা করতে পারে।'
তবে সব বিশেষজ্ঞ ভারত সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছে না।
যেহেতু এআই প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, তাই সরকারের পক্ষে এর লাগাম ধরে রাখা খুব কঠিন।
ডিপফেক শনাক্তকরণে বিশেষজ্ঞ মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাফিজ মালিক বলেন, এআই নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সংস্থাগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ছেড়ে দেওয়া বোকামি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত সরকারের অ্যাডভাইজরি আরোপের পদক্ষেপটি সঠিক।
তিনি বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে প্রবিধানগুলো আনা উচিত। তবে এগুলোর ফলে উদ্ভাবন ব্যাহত হওয়া উচিত নয়'।
তবে শেষ পর্যন্ত যা প্রয়োজন তা হলো বৃহত্তর জনসচেতনতা।
মালিক বলেন, 'এখন সর্বত্র মানুষ যা দেখছে, তাই বিশ্বাস করে। জনগণের সচেতনতা না থাকলে ডিপফেকের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অত্যন্ত জটিল সমস্যা সমাধানে সচেতনতাই একমাত্র হাতিয়ার।'
সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি