সূর্যগ্রহণের সময় প্রাণীদের মধ্যে কেন অস্থিরতা দেখা দেয়
সূর্যগ্রহণের সময় মানুষের মাঝে বিস্ময় দেখা যায়। তবে অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে? হঠাৎ করে যখন দিনের আলো স্বল্প সময়ের জন্য অন্ধকারে পরিণত হয়, তখন প্রাণীদের অনুভূতিই বা কেমন হয়?
সূর্যগ্রহণের এই সময়টি খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও এটি মানুষের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকের কাছেই ঘটনাটি বিস্ময়কর ও আশ্চর্যের। তবে সূর্যগ্রহণের সময় প্রাণীরা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকে সেটি অনুমান করা বেশ কঠিন। খবর বিবিসির।
প্রাণীরা দিনের ২৪ ঘণ্টাই জৈবিক ঘড়ির ওপর নির্ভর করে, যা দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান চক্র নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য, দেহঘড়ি বা সার্কাডিয়ান চক্র হলো একটি প্রাকৃতিক দোলন যার সাহায্যে প্রাণিদের ঘুম, শিকারসহ দৈনন্দিন কাজগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সূর্যগ্রহণ তাদের এই নিয়মমাফিক কাজগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করে, কিংবা কীভাবে এ কাজগুলোর ব্যাঘাত ঘটায়, তা তুলনামূলকভাবে এখনও অজানাই বলা যায়। আর এক্ষেত্রে সব প্রাণির প্রতিক্রিয়াও একরকম নয়।
সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির বিহেভিয়ারাল ইকোলজিস্ট সেসিলিয়া নিলসন বলেন, 'আলো উদ্ভিদ থেকে শুরু করে প্রাণী পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে।'
১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে নিউ ইংল্যান্ডের কীটতত্ত্ববিদ উইলিয়াম হুইলার এ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে সংঘটিত সূর্যগ্রহণের সময় প্রাণীদের আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি ৫০০ টিরও বেশি ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেন।
এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করে তিনি সূর্যগ্রহণের সময় পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পোকামাকড় ও বিভিন্ন উদ্ভিদের আচরণের পরিবর্তন দেখতে পান। তিনি লক্ষ্য করেন, প্যাঁচা এই সময়টায় তীব্র স্বরে ডাকতে শুরু করে এবং মৌমাছিরা তাদের মৌচাকে ফিরে যায়।
২০১৭ সালের আগস্টে সূর্যগ্রহণের সময় বিজ্ঞানীরা আবার একই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এবারও তারা বিস্ময়কর তথ্য পান। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা চিড়িয়াখানার বেশ কয়েকটি প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তারা লক্ষ্য করেন, সূর্যগ্রহণের কারণে অন্ধকার ছেয়ে যেতেই চিড়িয়াখানার জিরাফরা বিচলিত হয়ে ছুটতে শুরু করে। তারা আরও দেখতে পান, এই সময়টাও কচ্ছপরা যৌনক্রিয়ায় মিলিত হয় এবং ভোমড়া গুঞ্জন করা বন্ধ করে দেয়।
'সেদিন চিড়িয়াখানা ছিল অস্থির'
সাউথ ক্যারোলাইনার রিভারব্যাঙ্কস জু অ্যান্ড গার্ডেনের বিজ্ঞানী অ্যাডাম হার্টস্টোন-রোজ ২০১৭ সালের সূর্যগ্রহণের সময়ে তার অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানান, ওই দিন তিনি ভেবেছিলেন সূর্যগ্রহণের সময় হয়তো প্রাণীদের আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাবে না। কারণ, ঘটনাটি হয়তো প্রাণীদের কাছে বৃষ্টি বা মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশের মতো কোনো ঘটনাই মনে হবে। কিন্তু না। অন্ধকার শুরু না হতেই প্রাণীদের আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়। সেদিন চিড়িয়াখানা অস্থির হয়ে উঠেছিল। হাজার হাজার মানুষ ছিল চিড়িয়াখানায়। সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।
হার্টস্টোন-রোজ বলেন, 'সেদিন চিড়িয়াখানার এক–তৃতীয়াংশরও বেশি প্রাণীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেই সে সময় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।'
গ্রিজলি ভালুক সূর্যগ্রহণের সময় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পুরো সময়টিতে তাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে এবং কেউ কেউ খুব স্বাচ্ছন্দে কাটিয়েছে। একটি ভালুক মুহূর্তের জন্য মাথা ওপরের দিকে তুললেও আবার নামিয়ে নেয়।
অন্যদিকে নিশাচর পাখিদের খুবই বিভ্রান্ত মনে হয়েছিল। এসব পাখি সাধারণত দিনের বেলা বের হয় না। তারা রাতের বেলা খাবারের সন্ধানে বের হয়। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় তারা গাছ থেকে বেরিয়ে আসে। সূর্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পর তারা আবারও গাছে ফিরে যায়।
কিছু প্রাণীকে এই সময়ে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হয়েছিল। যেমন জিরাফ। সূর্যগ্রহণের সময় প্রাণীগুলো এমনভাবে ছুটতে শুরু করেছিল, যেন তাদের কোনো শিকারী প্রাণী তাড়া করেছে।
তবে বেশ অদ্ভুত আচরণ দেখা গেছে দৈত্যাকার কাছিমের বেলায়। সূর্যগ্রহণের সময়টায় কাছিমগুলো তাদের সঙ্গীর সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় মিলিত হয়েছিল।
যদিও চিড়িয়াখানাটি সেখানকার প্রাণীদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অনন্য একটি পরিবেশ ছিল, কিন্তু সেখানে কিছু অসঙ্গতিও ছিল। কারণ হিসেবে হার্টস্টোন-রোজ বলেন, 'ওই সময় চিড়িয়াখানায় বহু মানুষ ছিল। সূর্যগ্রহণ দেখে তারা বেশ উচ্চস্বরে চিৎকার করছিল। তাই এটি প্রশ্ন উঠছে যে আসলে প্রাণীগুলো র্সূযগ্রহণের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল- নাকি এত মানুষের চিৎকারে ঘাবড়ে গিয়েছিল।'
বনের পাখিদের প্রতিক্রিয়া
বিজ্ঞানীরা যে কেবল চিড়িয়াখানার প্রাণীদের ওপরই পর্যবেক্ষণ করেছেন তা নয়, তারা মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের ওপরও নজর রেখেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, তারা ভেবেছিলেন যে অন্ধকার ছেয়ে যাওয়ায় বনের পাখি ও অন্যান্য পোকামাকড় হয়ত ঘর ছেড়ে বের হয়ে আকাশে ওড়া শুরু করবে। যদিও বিজ্ঞানীরা আকাশে নজর রেখেছিলেন, কিন্তু অন্ধকারের জন্য তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তাই তথ্যের জন্য তারা আশেপাশের আবহাওয়া স্টেশনগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল।
এ বিষয়ে প্রধান গবেষক নিলসন বলেন, 'আমরা ওই সময়টায় আকাশে পাখির পরিমাণ কমে যেতে দেখেছিলাম। বেশিরভাগ পাখিই আকাশে ওড়া বন্ধ করে দিয়েছিল কিংবা নিচে নেমে আসছিল।'
নেব্রাস্কার প্লেট রিভার ভ্যালিতে অসংখ্য পাখির ওপর করা পরীক্ষায়ও বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, সেখানকার পাখিরা বিভিন্ন উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন, কিছু পাখি পুরোপুরিভাবে ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছিল।
বিপরীত চিত্র দেখা গেছে আমেরিকান গোল্ডফিঞ্চ ও চড়ুইয়ের বেলায়। তারা এ সময়টায় আরও জোরে ডাকাডাকি করতে শুরু করেছিল।
মানুষের মতোই অন্য প্রাণীরাও সূর্যেগ্রহণের সময় বিভিন্ন উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়টায় মাকড়সা তার জাল ছিড়ে ফেলে। সম্প্রতি এক গবেষেণায় দেখা যায়, অন্ধকার ছেয়ে যেতে শুরু করলে ভোমড়া গুঞ্জন বন্ধ করে দেয়।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক