আমরা কেন মারা যাই? বার্ধক্য ও অমরত্ব নিয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার
স্মরণকাল থেকেই মানুষ মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে কতই না চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞানের এ মহাযুগে এক সময়ের কল্পকাহিনির অনেক বস্তুই যখন বাস্তব, তখন গড় আয়ু বাড়ানোর ক্ষেত্রে বা অমর হওয়ার যাত্রায় আমরা কতদূর এগিয়েছি?
কিন্তু আমরা কি আদৌ চিরন্তন কোনো জীবন চাই? 'হোয়াই উই ডাই: দ্য নিউ সায়েন্স অব এজিং অ্যান্ড দ্য কোয়েস্ট ফর ইমমোরালিটি' শীর্ষক নতুন বইয়ে নোবেলজয়ী আণবিক জীববিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণান অতীত ও বর্তমানের গবেষণা ঘেঁটে আয়ু বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্ব ও বাস্তবিক সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছেন। সে সঙ্গে তিনি অমর হওয়ার প্রচেষ্টার সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছেন।
আজ থেকে দেড়শ বছর আগের আয়ুকে মানুষ বর্তমানে দ্বিগুণ করেছে। তাহলে কি আয়ু তিনগুণ বা চারগুণ করার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা? মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বার্ধক্য, মৃত্যু ও অমরত্ব নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন রামকৃষ্ণান।
সাক্ষাৎকারটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে প্রকাশ করা হলো।
প্রশ্ন: বয়স বাড়া কী? বার্ধক্য কীভাবে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়?
রামকৃষ্ণান: বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়ার মানে হচ্ছে আমাদের দেহের কোষের অভ্যন্তরের অণুসমূহের ক্রমাগত রাসায়নিক ক্ষয়, যার ফলে কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর কোষের ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটলে তার সঙ্গে টিস্যু এবং তারপর সার্বিকভাবে একটি জীবসত্তা হিসেবে আমরা ক্ষয়প্রাপ্ত হই।
মজার ব্যাপার হলো, গর্ভে থাকতে থাকতে আমাদের বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ওই সময় আমাদের কোষ যত দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে বেশি আমরা বৃদ্ধি পাই। আমাদের জীবনের একদম শুরু থেকেই বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আমাদের ডিএনএ-তে বয়সসংক্রান্ত ভুলগুলো শোধরানো এবং দেহের তৈরি করা নিম্নমানের প্রোটিনকে ঠিক করার জন্য আমাদের দেহে অনেক ধরনের মেকানিজমের বিবর্তন ঘটেছে। এসব ত্রুটিগুলো ঠিক করার উপায় না থাকলে আমরা এখন যতটা বয়স পর্যন্ত বাঁচি, সেটা কখনোই সম্ভব হতো না। তারপরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ক্ষয় তা সংশোধন করার সক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে যায়।
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিলেই আমাদের মৃত্যু ঘটে। কেউ মারা যাওয়া বললে আমরা বুঝি কোনো ব্যক্তির সম্পূর্ণরূপে মৃত্যু। আদতে আমাদের মৃত্যু হওয়ার পর আমাদের বেশিরভাগ অংশ, যেমন বিভিন্ন অঙ্গ জীবিত থাকে। এ কারণেই অপঘাতে মৃতদের অঙ্গদান করা যায়।
প্রশ্ন: মানুষের আয়ুর কি কোনো নির্ধারিত সীমারেখা আছে?
রামকৃষ্ণান: পৃথিবীর জীবসত্তাগুলোর আয়ুষ্কাল কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েকশ বছর হতে পারে। তা-তে হয়তো কেউ ধারণা করবেন, জন্মের পর একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছানোর পর সব জীবসত্তারই মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে মানুষের জন্ম হওয়াটা যেভাবে পারম্পর্য দ্বারা নির্ধারিত, মানুষের বয়োবৃদ্ধি আর মৃত্যুর অনুক্রমকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন না বিজ্ঞানীরা।
তার বদলে বিবর্তনের ধারায় প্রতিটি প্রাণী তাদের জীবনকাল সর্বোচ্চ করার জন্য সম্পদ বণ্টনের লক্ষ্যে একটি পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে। বড় প্রাণীগুলো সচরাচর বেশিদিন বাঁচে। ছোট প্রাণীগুলোর সাধারণত শিকারি প্রাণীর হাতে পড়ে মারা যাওয়া বা বন্যার পানিতে ডোবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বিবর্তনের দৃষ্টিতে এসব ক্ষুদ্র জীবসত্তার শারীরিক ক্ষতি সারাই করে এগুলোকে দীর্ঘ স্বাভাবিক আয়ু দেওয়ার জন্য বেশি সম্পদ ব্যয় করা অনর্থক। বরং বিবর্তন দ্রুতবর্ধনশীল প্রাণকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
গড় আয়ু হলো মূলত প্রাণীর জিন তার উত্তরসূরীতে স্থানান্তর করার সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ করার বিবর্তনীয় প্রচেষ্টা। মানুষের ক্ষেত্রে এ বিশেষায়িত সম্পদ বণ্টনের ফলে আমরা ১২০ বছরের মতো আয়ুষ্কাল পেয়েছি। কিন্তু তার মানে এ নয় যে আমরা জৈবিক বিজ্ঞানকে পালটিয়ে বিবর্তনের এ বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে আমাদের আয়ু বাড়াতে পারব না। বার্ধক্যবিষয়ক আরও অনেক বিজ্ঞানীর মতো আমিও বিশ্বাস করি, মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়ানো সম্ভব। তবে এ হস্তক্ষেপ কতটা সম্ভবপর হবে তা নিয়ে আমার মধ্যে অন্যদের মতো আশাবাদ নেই।
প্রশ্ন: বয়সের কাঁটা কি উলটো ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব কখনো?
রামকৃষ্ণান: প্রতিটি প্রজন্মেই বয়সের ঘড়ি উলটোদিকে ঘুরে বটে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের কোষ থেকে শিশুর জন্ম হলেও তার বয়স শুরু হয় শূন্য থেকে। ৪০ ও ২০ বছর বয়সি নারীর জন্ম দেওয়া উভয় শিশুরই বয়স কিন্তু শূন্য থেকেই শুরু হচ্ছে; তাদের দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ২০ বছর হচ্ছে না। তাই, কিছু পর্যায়ে বয়সের ঘড়ি উলটো হতে পারে।
আবার ক্লোনিং আছে। ক্লোন করা ডলি ভেড়া স্বাভাবিক আয়ুর চেয়ে অর্ধেক বাঁচলেও ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া অন্য অনেক ভেড়া স্বাভাবিক জীবন পেয়েছে। এর ফলে অনেকে মনে করেন, বিস্তৃত আঙ্গিকে বয়সের ঘড়ি আবার 'রিসেট' করা সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক কোষকে গবেষণাগারে ভ্রূণাবস্থায় নিয়ে আবারও সেটিকে বিকশিত করা সফল হলেও বাস্তবে সফল ক্লোনিংয়ের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক কোষের পূঞ্জীভূত ক্ষতি এতই বেশি যে সেগুলো থেকে আবারও নতুন প্রাণীর বিকাশ ঘটাতে বিপুল পরিমাণ গবেষণার দরকার।
প্রশ্র: ক্যান্সার বিজ্ঞান থেকে অ্যান্টি-এজিং গবেষণা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?
রামকৃষ্ণান: ক্যান্সার ও বয়োবৃদ্ধির মধ্যকার সম্পর্কটি জটিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একই জিনের ভিন্ন প্রভাব দেখা যেতে পারে; তরুণ বয়সে এসব জিন যেমন আমাদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তেমনি বৃদ্ধ বয়সে এ জিনগুলোই স্মৃতিভ্রংশ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে কারণ আমাদের ডিএনএ ও জিনোমে ত্রুটি জমাট বাঁধতে শুরু করে। এ ত্রুটি কোনো একসময় জিনকে অকেজো করে ক্যান্সার তৈরি করতে পারে। কোষের ত্রুটি সারাইয়ের অনেক ব্যবস্থা যেমন যৌবনে ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে, তেমনি সেগুলোকে শেষ বয়সে বার্ধক্য সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখতে দেখা যায়।
যেমন ডিএনএতে কোনো ধরনের বিযুক্তির ফলে ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিক সংযোগ তৈরি হতে পারে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। কোষ এ ধরনের বিযুক্তি ধরতে পারে। ক্রোমোজোমের অনিয়মিত সংযোগ প্রতিরোধে কোনো কোষ হয় নিজেকে ধ্বংস করে দেবে অথবা সেন্সিন নামক একটি অবস্থায় প্রবেশ করবে যেখানে কোষের পক্ষে আর বিভক্তি সম্ভব হবে না। আমাদের মতো জীবসত্তা, যার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ রয়েছে, তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হয়। এ পদ্ধতিতে কয়েক মিলিয়ন কোষ নষ্ট হয়ে গেলেও এর কারণে পুরো জীবসত্তাটি বেঁচে থাকে। কিন্তু এই সেনসেন্ট কোষ সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের বয়স বাড়ার একটি প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন: বার্ধক্য ও মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়ার এ যাত্রার সামাজিক দামটা কতটুকু? বিশেষ করে বৈষম্যের ক্ষেত্রে?
রামকৃষ্ণান: এখনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ১০ শতাংশ আয়কারী নিম্ন আয়ের ১০ শতাংশের তুলনায় এক দশকের বেশি সময় বাঁচেন। একজন মানুষের জীবনের স্বাস্থ্যকর বছরগুলোর দিকে তাকান, এ বৈষম্য আরও বেশি। দরিদ্র লোকেরা আয়ু কম পাচ্ছেন, তাদের জীবনও তুলনামূলক কম স্বাস্থ্যকর।
বার্ধক্যকে থামিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি আবিষ্কারে অনেক ধনী ব্যক্তি এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালছেন। এ ধরনের উদ্যোগ সফল হলে অতিধনীরা সবার আগে তার সুফল পাবেন। তারপর দেখা যাবে ভালো ইন্সুরেন্স থাকা ব্যক্তিরা আয়ু বাড়াচ্ছেন। এভাবে ধাপে ধাপে হবে এটি। দেখা যাবে, এ ধরনের প্রযুক্তি গরীব দেশের তুলনায় ধনী দেশ আগে পেয়ে গেছে। তাই দেশ ও বৈশ্বিক উভয়ভাবেই এ ধরনের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বৈষম্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।