গরুর জায়গা দখল করে নিচ্ছে উট; দুধ উৎপাদনের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে মেগাফার্ম
ডেইরি ফার্মের কথা চিন্তা করলে আমাদের চোখে কী ভাসে? খামারে রাখা সারি সারি গরু কিংবা ভেড়া, খামারি হয়ত গরু থেকে দুধ দোয়াচ্ছেন বা তাদের দেখভাল করছেন। কিন্তু কখনও কি উটের খামারের কথা মাথায় এসেছে?
বলা হচ্ছে ডেইরি ফার্মগুলোতে দুধের জোগানদাতা হিসেবে গরুর জায়গা আস্তে আস্তে দখল করে নিবে মরুভূমির উষ্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকা এ প্রাণীটি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন হাজার হাজার উট থেকে মেশিনের মাধ্যমে দুধ দোয়ানো হচ্ছে , আর সেই দুধ বাজারজাত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের কাছে।
হাজার হাজার বছর ধরে প্রাচীন যাযাবর ও পশুপালক শ্রেণীর মানুষদের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে আছে উটের দুধ। এমনকি দূর-দূরান্তের মরুভূমিতে পশু চরানোর সময় কয়েক সপ্তাহ শুধুমাত্র উটের দুধের ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকত তারা।
মরুভূমিতে দিনের প্রচন্ড গরম কিংবা ঠান্ডা রাতের সাথে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে উট, প্রতিকূল পরিবেশের সাথে তাদের জীবন হয়েছে আবর্তিত। অল্প কিছু জল বা গাছপালা দিয়ে টানা কয়েক দিন কাটিয়ে দিতে পারে। গরু, ভেড়া এবং অন্যান্য গবাদি পশুর চেয়ে মিথেনও অনেক কম মাত্রায় উৎপাদন করে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো উটকে জলবায়ু পরিবর্তনের মাঝে অনন্য ও মূল্যবান করে তোলে। এ কারণে, তারা পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে, বিশেষত মরুভূমি এবং অন্যান্য শুষ্ক অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যাইহোক, এই একই গুণাবলী তাদের খামারিদের কাছেও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বড় কর্পোরেশনগুলো জলবায়ু উদ্বেগ মোকাবেলার সুযোগে উট চাষ করে মুনাফা অর্জন করছে এবং উট শিল্প প্রসারিত হচ্ছে।
তবে উদ্বেগের ব্যাপার এই যে শিল্পায়িত উট পালনের এ পরিবর্তন কেবল পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে না, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যগত জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও হারিয়ে যাবে। 'মরুভূমির জাহাজ' নামে পরিচিত এ প্রাণীগুলোর জীবন যদি খামারের ছোট ছোট ঘেরেই শেষ হয় তাহলে তা আমাদের জন্য হবে লজ্জাজনক ।
বাড়ছে উটের দুধের চাহিদা
গরু, ভেড়া এবং ছাগলের দুধের বিকল্প হিসেবে উটের দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে যেমন— মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমি বা ওমানের মরুভূমিতে উটের দুধ এবং এ দুধের চা খাওয়া হয়। এটি থেকে লাবান, মাঠা বা দইও তৈরি করা হয়।
খামারিদের উৎপাদিত উটের দুধে একটি মৃদু স্বাদ রয়েছে, মৌসুম ভেদে কখনও এটি কিছুটা মিষ্টিও হয়।
শুষ্ক অঞ্চলের পশুপালকরা সর্বদা উটের দুধ খেয়ে থাকে, তবে বাজারজাত করা দুধের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তার হালকা স্বাদ, নিম্ন ল্যাকটোজ এবং পুষ্টি মানের কারণে।
আর গরুর ডেইরি খামারের তুলনায় এটি পরিবেশবান্ধবও বটে। এছাড়া পুষ্টিগুণের দিক থেকেও গরুর দুধের চেয়ে উটের দুধ অনেক আলাদা। উটের দুধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি-এর পরিমাণ অনেক বেশি এবং এতে চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকে।
গরুর দুধের মিল্ক ফ্যাটের তুলনায় মহিষ, ভেড়ির দুধ ও উটের দুধে লিনেওলিক এসিড বেশি থাকে যা শরীরের জন্য বিভিন্নভাবে উপকারী। সেই সাথে উটের দুধে ল্যাক্টিক এসিড ব্যাক্টেরিয়ার ১২০ স্ট্রেইন উপস্থিত থাকে যা অন্ত্রের পরিপাকে সাহায্য করে। এছাড়া, উটের দুধের মধ্যে প্রোবায়োটিক উপাদানও থাকে প্রচুর।
তবে উটের দুধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর মধ্যে ল্যাক্টোজ অসহিষ্ণু মানুষদের ক্ষতির কারণ হওয়ার মতো উপাদান, বি-ল্যাক্টোগ্লোবুলিন থাকে না। এই উপাদান না থাকার ফলে সব শ্রেণীর মানুষই উটের দুধ খেতে পারেন।
তরল ও গুঁড়ো উটের দুধের চাহিদার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট উটের খামার গড়ে উঠছে। যেমন– অ্যামিশ এবং সৌদিরা মিলে যুক্তরাষ্ট্রেও অনেকগুলো উটের খামার গড়ে তুলেছে। উদ্যোক্তারা এখন দুগ্ধবতী গাভীর মতো বেশি দুধ উৎপাদন করে এমন উট পালনের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
বিশাল উটের দুগ্ধ খামার
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং সৌদি আরবে হাজার হাজার উট নিয়ে উটের দুগ্ধ খামার স্থাপন করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় খামারটিতে ১০ হাজারেও বেশি উট রয়েছে। উটের মাংস বিক্রির জন্য পুরুষ উটকে মোটাতাজা করার ইউনিটও রয়েছে। এর মধ্যে আরও খামার নির্মিত হচ্ছে এবং ২০২৪ সালের গোড়ার দিকে সৌদি সার্বভৌম সম্পদ তহবিল এই খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
শিল্প পর্যায়ে উট পালনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পুরুষ উট প্রজনন মৌসুমে খুব আক্রমণাত্মক এবং এমনকি মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে স্ত্রী উট গর্ভধারণে গরুর চেয়ে বেশি সময় নিয়ে থাকে।
তবুও, দশকের শেষের দিকে বিশ্বব্যাপী উটের দুধের বাজারমূল্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলারে (১০ বিলিয়ন পাউন্ড) পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে উট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। উটের দৌড় এবং সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাগুলোতে কখনও কখনও ২ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এ কারণে উটের ওপর ক্লোনিংয়ের মতো উন্নত প্রজনন কৌশলগুলো আরও সাধারণ হয়ে ওঠছে।
স্থানীয় উট পালকরা উদ্বিগ্ন
গ্রামীণ মঙ্গোলিয়ায় এবং আরবের মরুভূমির উটগুলো কোনও ধরনের বেড়া ছাড়াই অবাধে ঘুরে বেড়ায় এবং হাত দিয়ে তাদের দুধ দোয়ানো হয়। সেখানকার পশুপালকরা শিল্পগতভাবে বড় আকারের মেগাফার্ম তৈরি হওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
ভারতের রাজস্থানে সম্প্রতি এক কর্মশালায় জড়ো হওয়া বিভিন্ন দেশের উট পালনকারীরা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছেন যে, তারা শিল্পায়িত উট পালনের মডেল গ্রহণ করার বিষয়ে সতর্ক যা জীবাশ্ম জ্বালানি, রাসায়নিক এবং আমদানি করা ফিডের ওপর নির্ভরশীল।
ইতিহাস জুড়ে দেখা গেছে মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে উটের উপর নির্ভর করেছে, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগিয়েছে। মানুষ বাণিজ্য, পরিবহন এবং এমনকি যুদ্ধের মতো অনেক কিছুর জন্য উট ব্যবহার করেছে। আজকাল পর্যটনের বিজ্ঞাপনেও এদের প্রায় দেখা যায়।
কিন্তু উট পালনকে শিল্পায়িত করা অর্থাৎ যেখানে উটকে শুধু বেশি দুধ উৎপাদনের জন্য সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, তা নিয়ে আমাদের পুনরায় ভাবা উচিত। যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উট পালন করে আসছে, প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে পশম, দুধ, দুগ্ধজাত পণ্য এবং মাংস উৎপাদন করে তাদের ওপর, উট পালনের এ রূপান্তর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন