ধীরগতির মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বাজেটে নেই দিক-নির্দেশনা
এক দশকের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে দোহাজারি-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। ২০১০ সালে বাস্তবায়ন কাজ শুরু হওয়া প্রকল্পটির কয়েক দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের এখনও পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৫৭ শতাংশ। তারপরও, অর্থায়ন এবং ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে খুবই ধীর গতিতে।
শুধু এই প্রকল্পটিই নয়, সরকারের বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ের বাইরে গিয়ে বছর পর বছর ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে যোগাযোগ খাতের পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসেতুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পই রয়েছে।
মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গত এই দশায় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় মেগা প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক আশার কথা শুনিয়েছেন। তবে তার বক্তব্যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কোনো দিক-নির্দেশনা আসেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, "যোগাযোগ খাতের অনেক প্রকল্প থেকে এখন আমাদের সুফল ভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু, বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণে এসব প্রকল্পের সুফল থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।"
তিনি বলেন, এর মধ্যে অনেক প্রকল্পে এখন একটু গতি বাড়ালে দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ শেষ করা সম্ভব। তবে সে জন্য সরকারের নজরদারি জোরদার করতে হবে। একইসঙ্গে, বরাদ্দ ও অর্থছাড়ও নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, "উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আধুনিক, নিরাপদ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করা অসীম গুরুত্বের। এই লক্ষ্য পূরণে আমাদের সরকার সুসংহত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে সড়ক, সেতু, রেলপথ নির্মাণসহ নৌ ও আকাশপথে সংযোগ বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।"
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বাস্তবায়ন শেষ হওয়া সড়কের চার লেনে উন্নীতকরণের কিছু মেগা প্রকল্প কথা উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে, ঢাকা- চট্টগ্রাম চার লেনের হাইওয়ে, ঢাকা- ময়মনসিংহ জাতীয় হাইওয়ে এবং নবীনগর- চন্দ্রা হাইওয়ে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু, এসব প্রকল্পের কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। লক্ষ্যমাত্রার দীর্ঘসময় পর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়।
এ বাস্তবতায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের চলমান ২৬ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেজ্ঞরা।
এদিকে অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে আগামী বছরের জুনে পদ্মা সেতু এবং ডিসেম্বরে মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) প্রকল্পের একটি অংশ উত্তরা থেকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এই দুই প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প দুটির এখনকার অগ্রগতি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব। তবে এর জন্য অবশ্যই সরকারের তদারকি জোরদার করতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতেও যাতে উল্লেখিত সময়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায় সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কৌশল নিতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, আগামী অর্থবছরের জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে বাস্তবায়ন কাজ চলছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কিছু ঘাটতি থাকলেও, আশা করা যাচ্ছে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬.৭৩ কি.মি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ পূর্ণ গতিতে চলছে। (এয়ারপোর্ট- বনানী) পর্যন্ত প্রকল্পের প্রথম ধাপের বাস্তব অগ্রগতি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৬০ শতাংশ ছিল। একইসময়, সম্পূর্ণ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ছিল ২৪ শতাংশ। এছাড়া, গাজীপুর থেকে হজরত শাহজালাল বিমান বন্দর পর্যন্ত ২০ কি.মি বাস র্যাপিড ট্র্যানজিট লেনের (বিআরটি) কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পের প্রথম টিউবের কাজ শেষ হওয়ার পর, দ্বিতীয় টিউবের নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
এছাড়া, হজরত শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে সাভার ইপিজে ভায়া আশুলিয়া পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটারের ঢাকা- আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ দুই দেশের সরকারের (জিটুজি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে করছে চায়না ন্যাশনাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি)। বর্তমানে প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে বলে জানান আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এদিকে প্রায় এক দশক ধরে বাস্তবায়নাধীন খুলনা- মোংলা রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ ৭৭.৫ শতাংশ শেষ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
মন্ত্রী জানান, বিশ্বের শীর্ষ একশ কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর স্থান পেয়েছে, এবং মাত্র ১০ বছর পর ২০১৯ সালে ৩৪ ধাপ এগিয়ে ৬৪তম স্থান অধিকার করে।
মুস্তফা কামাল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি বিশ্বমানের বন্দরে রূপান্তরিত করতে পতেঙ্গা-হালিশহর উপকূলে বে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। এতে জাহাজের টার্নএরাউন্ড সময় ৩৬ ঘণ্টা থেকে কমে ২৪ ঘণ্টায় নামবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম বলেন, বে- কইন্টেইরা টার্মিনাল হবে তিনটি। এরমধ্যে একটি নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাকি দুটি নির্মিত হবে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি)।
এখন ডিজাইন তৈরির কাজ চলছে। একইসঙ্গে, অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্থার আলোচনা চলছে। এরপর বাস্তবায়ন কাজে যাওয়া সম্ভব হবে। অন্যদিকে, দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ আগামী বছর শুরু করার লক্ষ্য রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, বছর ভিত্তিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা গেলে ২০২৫ সালের মধ্যে এ বন্দরের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।