ভারতে চলছে দ্বিতীয় দফায় ভোট; মোদির মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যের পর উত্তপ্ত ভোটের মাঠ
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে আজ (২৬ এপ্রিল) । দেশটির ১৩ রাজ্যের ৮৮টি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ চলবে। স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় শুরু হওয়া এ ভোট চলবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
১ জুন পর্যন্ত চলা এই নির্বাচনে প্রায় ৯৭ কোটি ভোটার ভোট দিবেন যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি। লোকসভার মোট ৫৪৩টি নির্বাচনী আসনে সাত দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে আর ভোট গণনা হবে ৪ জুন। প্রথম ধাপে মোট ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১০২টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন 'ইন্ডিয়া' জোটের মধ্যে মূল লড়াই হতে যাচ্ছে। জোটগতভাবে ৪০০ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখছে ক্ষমতাসীন জোট এনডিএ। আর এককভাবে ৩৭০ আসনের টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে জোটটির মূল দল ভারতীয় জনতা পার্টি।
দ্বিতীয় দফার ভোটে গুরুত্বপূর্ণ আসন ও প্রার্থী কারা?
দ্বিতীয় দফার এ নির্বাচনে ভারতের কর্ণাটক, কেরালা, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, মণিপুর, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং জম্মু-কাশ্মীরে ভোটগ্রহণ হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় সবচেয়ে বেশি ভোটগ্রহণ হবে দক্ষিণের রাজ্য কেরালায়। এই রাজ্যের ২০টি লোকসভা আসনের সবকটিতেই ভোট হবে এদিন। সাধারণত এ রাজ্যে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে তুমুল লড়াই হয় তবে এখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপি, তবে এখন পর্যন্ত কোনো আসন জিততে পারেনি তারা।
চলতি নির্বাচনে কেরালায় মোট ভোটার ২৭.৭৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ কোটি ৪৩ লাখ।
কেরালা রাজ্যের ওয়ানাড থেকে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসের প্রার্থী রাহুল ২০১৯ সালের নির্বাচনেও ওয়ানাড কেন্দ্র থেকে জয় পেয়েছিলেন। বিগত নির্বাচনে তিনি উত্তর প্রদেশের আমেঠি কেন্দ্রে স্মৃতি ইরানির কাছে হেরেছিলেন। কেরালা রাজ্যের ওয়েনাদ কেন্দ্র থেকে গত নির্বাচনে ৪.৩১ লাখ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। রাহুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এবার নির্বাচনের মাঠে আছেন বিজেপির কে সুন্দরন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) অ্যানি রাজা।
কেরালার তিরুঅনন্তপুরম থেকে এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াই করছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজিপির প্রার্থী রাজীব চন্দ্রশেখর এবং কূটনীতিবিদ ও কংগ্রেসের বর্তমান সাংসদ শশী থারুর। এই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন পান্নিয়ান রবীন্দ্রন।
এছাড়া বিজেপি প্রার্থী হিসেবে উত্তরপ্রদেশের মথুরার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ফের লড়ছেন বলিউড অভিনেত্রী হেমা মালিনী। তিনি দুই মেয়াদে আসনটি ধরে রেখেছেন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস প্রার্থী মুকেশ ধাঙ্গর।
উত্তর প্রদেশের মিরাট থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন অভিনেতা অরুণ গোভিল। এ আসনে তার মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সপার সুনীতা বর্মা ও বসপার দেবব্রত কুমার ত্যাগী।
রাজস্থানের কোটা থেকে এবারও বিজেপির প্রার্থী লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা। ২ বারের সাংসদ ওম বিড়লার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন প্রহ্লাদ গুঞ্জল।
ছত্তিশগড়ে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল এবার রাজনন্দগাঁও কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন। সেখানে তার প্রতিপক্ষ বিজেপির নেতা সন্তোষ পান্ডে। রাজনন্দগাঁও কেন্দ্র মূলত বিজেপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত।
বেঙ্গালুরুর রুরাল কেন্দ্রে কর্ণাটকের উপমুখ্যমন্ত্রী ডিকে শিবকুমারের ভাই ডিকে সুরেশ কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন বিজেপি-জেডিএস জোটের সিএন মঞ্জুনাথ।
এই নির্বাচনকে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এটি মোদির রাজনৈতিক আধিপত্যের সীমা পরীক্ষা করবে। নির্বাচনে জিতলে জওহরলাল নেহরুর পর মোদিই হবেন দ্বিতীয় ভারতীয় নেতা যিনি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসবেন।
বেশিরভাগ জরিপে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিস্তৃত বিরোধী জোট এবং শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলোর বিরুদ্ধে মোদি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
ফের ক্ষমতায় আসতে মোদির মুসলিমবিদ্বেষী আচরণ
তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে পারেন এমন ভবিষৎবাণী অনেকে করলেও নির্বাচনী সমাবেশে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে আবারও বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রি নরেন্দ্র মোদি। ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস দেশের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে সম্পদ বিলিয়ে দেবে এবং ভারতীয় মুসলিমদের 'অনুপ্রবেশকারি' তকমা দিয়ে মোদির এমন বক্তব্য নিয়ে ভারতের রাজনীতি এখন উত্তপ্ত।
কংগ্রেস ও মুসলমানদের নিয়ে এই ভাষণ ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। মোদির মন্তব্য আচরণবিধি ভঙ্গ করে কিনা তা খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন বিরোধীরা।
মোদি এমন মন্তব্যের জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন, অনেকে আশঙ্কা করছেন যে বিজেপি তৃতীয় মেয়াদ ক্ষমতায় আসলে দেশজুড়ে ইতোমধ্যে চলমান সাম্প্রদায়িক ফাটলকে আরও গভীর করবে।
প্রথম দফার ভোটে ভোটারদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, ভোটের শতাংশের হার বিজেপিকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ২০১৯ সালের গড় হার ৬৬ শতাংশের মতো হলেও এবার তা নেমে এসেছে ৬৩ শতাংশে। বিজেপির শক্তিশালী অঞ্চল মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কেন্দ্রগুলোতেও ভোটের হার কমেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে অনুযায়ী, স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবগুলো আসন মিলিয়ে ভোট পড়েছে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে তামিলনাড়ুতে ভোট পড়েছে ৬৩.২ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০.৩ শতাংশ, উত্তর প্রদেশে ৫৭.৫ শতাংশ এবং মধ্যপ্রদেশে ৬৩.৩ শতাংশ।
দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিলাল আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রি নরেন্দ্র মোদি কখনও সরাসরি এভাবে মুসলিমদেরকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেননি, এবারই প্রথম। হিলালের মতে, ২০১৯-এ যে সব এলাকায় বিজেপি ভালো ফল করেছে, সেখানে এবার ভোটার উপস্থিতি কম। ভোটারদের উপস্থিতি ও সমর্থন বাড়াতেই এবার সরাসরি মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছেন মোদি। তিনি তার অনুগত সমর্থকদের কাছ থেকে আরও বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই এমন পথ বেঁছে নিয়েছেন।
মুসলিম ভোটারদের কী ভাবনা?
৩২ বছর বয়সী মুসলিম ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বেঙ্গালুরুর একটি ভোটকেন্দ্রে শুক্রবার সকালে ভোট দিতে যান।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, 'আমরা ১০ বছর ধরে বিজেপিকে দেখছি। আমরা শুধু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, মিথ্যা আর অকৃত প্রতিশ্রুতি দেখেছি। বিজেপি শুধু ধর্মের নামে দেশ ও মানুষকে বিভক্ত করেছে।'
'ধর্মনিরপেক্ষ নেতা থাকলে ধর্ম নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সবাইকে সাহায্য করার মানসিকতা থাকবে। অনেককে চাকরি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। কিছুই হয়নি।', যোগ করেন সাদ্দাম।
সাদ্দাম আরও বলেন, নতুন নেতাকে বেকারত্ব, শিক্ষা, দরিদ্রদের উন্নয়ন, পানির ঘাটতি মোকাবেলা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সবার জন্য উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
নতুন সরকার নিয়ে নবীন বা 'জেন-জি' ভোটাররা কী ভাবছেন?
এবারের নির্বাচনে ১৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রথমবারের মতো ভোট দিবেন। তাই তাদের দেওয়া প্রথম ভোট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে নির্বাচনের ফলাফলে।
২৩ বছর বয়সী শিক্ষক এবং প্রথমবারের ভোটার আসমা হামাদ শেখ শিক্ষা এবং সামাজিক ঐক্যকে কেন্দ্র করে একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন।
তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে, নিরক্ষরতা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে। আশা করছি সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত হবে।' ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আসমা তার শৈশব থেকে স্মরণ করা সম্প্রীতিতে ফিরে যাওয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষা করেন।
আসমার ভাষ্যে, 'আমি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অনেক লড়াই দেখেছি, আমি এই বিভাজনকে বড় হতে দেখিনি। গত কয়েক বছরে এটা অনেক বেড়ে গেছে।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন