ডিম আগে না মুরগি আগে? এ প্রশ্নের সমাধানে এগিয়ে এলেন এক জীববিজ্ঞানী
জীববিজ্ঞানের লেখক হিসেবে প্রায়ই আমাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, "ডিম আগে না মুরগি আগে?" কখনো কোন শিক্ষার্থী ক্লাসের শেষে দুষ্টুমি করে আমাকে এ প্রশ্ন করলেও সে হয়ত জানে না যে এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে অনেকবারই হতে হয়েছে।
বহু বছর আগে প্রাণীর ডিম কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং পৃথিবীতে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিয়ে আমি যখন গবেষণা শুরু করেছিলাম তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম এটিই সম্ভবত একমাত্র প্রশ্ন যা আমাকে করা হবে।
বছরের পর বছর আমি ডিমের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন কীভাবে হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করেছি। মাটিতে এর যাত্রা থেকে শুরু করে মহাদেশ জুড়ে এর ভ্রমণ পর্যন্ত এটি কীভাবে অভিযোজিত হয়েছে তা অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছি। আমি নাভির কর্ড, প্ল্যাসেন্টা, মেন্সট্রুয়েশন এবং মেনোপজের বিবর্তনের বিষয়গুলো অনুসন্ধান করেছি। এখন যেহেতু আমি আমার সুদীর্ঘ যাত্রাকে একটি বইয়ে রূপান্তর করেছি, আমি আশা করি পাঠকদের সাথে আমার কথোপকথনের বেশিরভাগ অংশ মুরগিকে কেন্দ্র করেই হবে।
যদি কেউ প্রাণীর ডিম কতটা চমৎকার হতে পারে সে নিয়ে আগ্রহ পোষণ করেন এবং সেটি নিয়ে প্রায়ই চিন্তা করেন তাহলে তাদের জন্য মুরগি একটি আগ্রহের প্রজাতি হতে পারে বলে আমি মনে করি।
এখন তাহলে প্রশ্ন জাগছে, ডিম আগে না মুরগি আগে?
এরকম একটি পুরোনো ও জনপ্রিয় প্যারাডক্স মূলত মানব মস্তিষ্কের একটি জটিল প্রক্রিয়াকে তুলে ধরে যেখানে মানুষ সবসময়েই একটি ঘটনার ওপর নির্ভরশীল আরেকটি ঘটনার প্রবাহকে ঠিক করে সাজাতে গিয়ে জটিলতা অনুভব করে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এরিস্টটল এ ধরনের জটিলতাকে ইনফিনিটি সিক্যুয়েলের (অসীম ধারা) একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন যার কোন সঠিক সূচনা নেই। এরিস্টটলের কাছে কীভাবে ইনফিনিটি কাজ করে তা ভাবার একটি উপায় ছিল এটি।
পরবর্তীতে গ্রিক ইতিহাসবিদ ও আত্মজীবনী লেখক প্লুটার্ক ডিম এবং মুরগির জটিলতাকে একটি 'কঠিন ও গুরুতর সমস্যা' বলে অভিহিত করেছিলেন। তার মতে, এটি দার্শনিকদের পৃথিবীর কোনো শুরু আছে কিনা বা সেটি কখনো শেষ হবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিল।
'ডিম আগে না মুরগি আগে?' প্রশ্নটি ছিল মহাবিশ্ব, সময় এবং পদার্থবিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আজকের বড় প্রশ্নগুলোর প্রাথমিক সংস্করণের মতো। তারপর উনিশ শতকের জীববিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদরা প্রমাণের ভিত্তিতে এ প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দিতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা নিয়ে আসা চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের মতো বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
যদি আপনাদের মনে হয় ডিম মূলত খোসা সদৃশ একটি বস্তু যেটিকে চামচ দিয়ে ছাড়ানো যায় তাহলে ডিম অবশ্যই মুরগির অনেক আগেই এসেছে। কারণ সব পাখিই ডিম পাড়ে এবং লক্ষ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষা ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মুরগি পৃথিবীতে এসেছে ১০ হাজার বছর বা তার কিছু সময় আগে। সুতরাং, মুরগি এবং ডিম এর মধ্যে ডিম প্রথমে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে খোসাযুক্ত ডিমগুলো প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর আগে আধুনিক পাখিদের পূর্বপুরুষ সহ নির্দিষ্ট ডাইনোসর গোষ্ঠীতে বিবর্তিত হয়েছিল। অন্যান্য কিছু ডাইনোসর গোষ্ঠী যেমন সরোপডের ডিম প্রায় ১৯৫ মিলিয়ন বছর আগেই খোসাযুক্ত ছিল। তাই বলাই যায়, প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর বয়সী ডিম মুরগির আগেই পৃথিবীতে এসেছে যেহেতু মুরগির বয়স মাত্র ১০ হাজার বছর।
কিন্তু আমি এ ধরনের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কারণ সব প্রাণীর ডিম একরকম হয় না, এমনকি প্রজাতিভেদে পাখির ডিমের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ডিমের ভিন্নতার মূল কারণ হল ডিম্বাশয়। প্রাণীভেদে ডিম্বাশয়ের ভিন্ন গঠনের জন্যই আমরা ভিন্ন ধরনের ডিম দেখতে পাই। মুরগির ডিম্বাশয়ের গঠন ও কাজ সত্যিকার অর্থে একটি চমকপ্রদ বিষয়।
আপনার রান্নাঘরে পৌঁছানোর আগে মুরগির প্রতিটি ডিমকে একটি অসাধারণ যাত্রার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথমে মুরগির ডিম্বাশয়ে ডিমের আবরণটি খোসা ছাড়া একটি পিচ্ছিল গোলকসদৃশ অবস্থায় থাকে। ডিম্বাশয়ের ভেতরে থাকা কিছু বিশেষ ছিদ্র থাকে যা থেকে সেগুলোতে রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হয়। রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ক্যালসিয়াম অন্যতম। এর ফলে ডিমটির ওপরে ক্যালসিয়ামের একটি আস্তরণ পড়ে যার জন্য ডিমের ওপর শক্ত খোসার সৃষ্টি হয়। ভিন্ন ভিন্ন পাখির ডিম্বাশয় থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থের ওপর ভিত্তি করে ডিমের আকৃতি, খোসার রং এবং খোসার পুরুত্বের ভিন্নতা দেখা দেয়।
তাহলে আমরা আমাদের প্রশ্নটিকে আরেকটু পরিমার্জিত করে জিজ্ঞাসা করতে পারি, ডিম আগে না ডিম্বাশয় আগে? যদি ডিম না থাকত তাহলে ডিম্বাশয়ের আসলে কি কাজ ছিল? আমরা যদি আরো গভীরে যাই তাহলে দেখতে পাবো, ডিম্বাশয় বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই ডিম এসেছে। বিভিন্ন জীবাশ্মের (ফসিল) রেকর্ড দেখে বলা যায়, সময়টা কয়েক লাখ বছর বার তার থেকেও বেশি হতে পারে।
অবিশ্বাস্যভাবে ডিম অনেক প্রাচীন, ৬০০ মিলিয়ন বছর বা তারও বেশি সময় আগের। আমরা প্রাচীন সমুদ্রের তলগুলোতে গোলকের মতো নমুনা দেখতে পেয়েছি যেগুলোর আকৃতি মাত্র এক মিলিমিটারের মতো এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল। কয়েকটি নমুনার মধ্যে আদিম কোষ ছিল বলে যুক্তি দেয়া হয়েছে। আদিম কোষগুলো দুই, চার, আট, ষোল ক্রমধারায় বিভাজিত হয়ে সেখান থেকে একটি ভ্রূণে রূপান্তরিত হয়ে তা থেকে একটি বাচ্চার জন্ম দিয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার করার সক্ষমতা রাখে।
আমরা এখন এই প্রাচীন ডিমগুলো থেকে আগত প্রাণী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ধারণা করা হয়, প্রাণীগুলো জেলিফিশ বা আদিম সামুদ্রিক পতঙ্গ হতে পারে। এই জীবাশ্ম ডিমগুলো মুরগি এবং ডিম্বাশয় থেকে অনেক বেশি পুরোনো। জীবাশ্মগুলো এডিকারান যুগের, প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর আগের। পালক, কঙ্কাল, চোখ এবং ঠোঁট সহ একটি মুরগির অস্তিত্ব তখনকার সময়ে জীবিত যে কোন প্রাণীর কথা ভাবলে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ছিল। তবুও সম্ভবত এ সময়ের আগেও পৃথিবীতে ডিমের অস্তিত্ব ছিল।
যদি আমরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মতো যৌন কোষ বিবেচনা করি তাহলে ডিম মুরগির প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগেই পৃথিবীতে এসেছে। শৈবাল, গাছ এবং প্রাণী (অধিকাংশ সময়ে এককোষী জীব) সহ আধুনিক যুগের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রাণীর যৌন প্রজননের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, ডিম এবং শুক্রাণু সম্ভবত প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগে বিবর্তিত হয়েছিল। অর্থাৎ আজকে আমরা যে প্রাণীগুলোকে চিনি সেগুলো বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর অস্তিত্ব ছিল, এমনকি ডিম্বাশয়েরও বহু বছর আগে।
তাই এ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্যারাডক্সের উত্তর হলো, ডিম আগে। ডিম বয়সে মুরগির থেকেও বড়। তাই কেউ যখন আমাকে প্রশ্নটি আবার করবে তখন আমি ডিমের কথাই বলবো।
যখন আমরা জেনেটিক্স এর কথা বিবেচনা করি তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আছে যেখানে মুরগির পূর্বপুরুষ 'বন্য ফাউল' একটি নিষিক্ত ডিম পেড়েছিল। সেই ডিমের মধ্যেই সঠিক মিউটেশনের মধ্য দিয়েই সেটি পরবর্তীতে 'মুরগি' হিসেবে বিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু একটি 'মুরগি' আসলে কি? এটা কি বাড়ির উঠানে ঘুরে বেরানো ঐতিহ্যবাহী পাখি, নাকি পোল্ট্রি শিল্প দ্বারা প্রজনন করা আধুনিক ব্রয়লার? শতাব্দী ধরে 'মুরগি' ধারণাটি জিন ও জেনেটিক বিবর্তনের একটি প্রবাহিত নদী যা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা মানুষের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। 'মুরগি' নিয়ে ধারণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান কারণ মানুষ প্রাণীকে শ্রেণিবদ্ধ করতে পছন্দ করে।
মুরগি নাকি ডিম? ডিম নাকি ডিম্বাশয়? ডিম নাকি প্রাণী? এই প্রাচীন প্যারাডক্স যা নিয়ে ২ হাজার বছর আগেও চিন্তা করা হয়েছিল, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ এখনো কমেনি। বিজ্ঞানের এরকম উন্নতির যুগে এসেও প্রশ্নটি আমাদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। ডিম যেটি থেকে প্রতিটি আধুনিক প্রাণীর জীবনের শুরু, সত্যিই অসাধারণ সৃষ্টি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়