‘হিন্দস হল’ গানে গাজা নিয়ে বাইডেনের সমালোচনা মার্কিন র্যাপারের
গাজা নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। তবে ইহুদি বিদ্বেষের দোহাই দিয়ে কঠোরভাবে এসব বিক্ষোভ দমন করছে পুলিশ। মূলধারার মার্কিন গণমাধ্যমও একে ইহুদি বিদ্বেষ বলে প্রচার করছে। রাজনীতিবিদরা জানাচ্ছেন নিন্দা, অথচ গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় তারা প্রকাশ্য সমর্থন দিচ্ছেন।
এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সত্যিকারের বাস্তবতা তার নতুন গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন গ্রামি পুরস্কারজয়ী র্যাপগায়ক ম্যাকেলমোর। এই গানে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কঠোর সমালোচনাও করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁকে ভোটও দেবেন না তিনি।
গত সোমবার মুক্তি পায় 'হিন্দস হল' নামের এই গান। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর আগে ক্যাম্পাসের একটি ভবন দখলে নিয়ে নিহত এক ফিলিস্তিনি শিশু রজব হিন্দের স্মরণে এর নাম বদলে রেখেছিলেন হিন্দস হল – সে থেকে গানটির এ নামকরণ।
গানের কথায় ম্যাকেলমোর দখলদার, উপনিবেশবাদী ইসরায়েলকে অব্যাহতভাবে অর্থায়ন করে চলায় মার্কিন সরকারের তীব্র নিন্দা জানান। আর প্রশংসা করেছেন, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর ছাত্রদের। যারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক থাকা প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি তুলেছে।
র্যাপের ছন্দে ম্যাকেলমোর বলেছেন, "সমস্যা প্রতিবাদ নয়, বরং যার জন্য প্রতিবাদ হচ্ছে –সেটাই মূল সমস্যা। আমাদের দেশ যেখানে অর্থায়ন করছে –এটি তার বিরুদ্ধে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরাও বলেছেন, ইসরায়েল গাজায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞে চালাচ্ছে, তবু ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখছেন বাইডেন। এর প্রতিবাদে তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনকে বর্জন করবেন। ম্যাকেলমোর কণ্ঠেও শোনা গেল তাদের সাথে সহাবস্থানেরই সুর।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের চড়াও হওয়ার নিন্দাও করেছেন তিনি। শান্তিপূর্ণ এসব বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি দমনে কর্তৃপক্ষের পুলিশের সহায়তা নেওয়াকে তিনি অবৈধ বলে অভিহিত করেছেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলসের শিক্ষার্থীর লক্ষ্য করে রাবার বুলেটও ছুড়েছে পুলিশ। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে গ্রেপ্তারের অভিযোগও উঠেছে। এতে তাদের অনেকেই আহতও হয়েছেন।
'হিন্দস হল' গানের তাৎপর্য যেখানে
এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের একজন গ্রামি-জয়ী বড় মানের সঙ্গীতশিল্পী গাজা যুদ্ধ নিয়ে নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করলেন।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলার সময় ২৯ জানুয়ারি সকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা সিটির বাসিন্দাদের শহরের পশ্চিমাঞ্চল খালি করে উপকূলীয় সড়ক ধরে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছিল। সেদিন রজবকে নিয়ে তার চাচা, খালা এবং পাঁচ চাচাতো ভাই বাড়ি ছাড়েন দক্ষিণে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু, পথিমধ্যে তাদের গাড়িতে হামলা করে ইসরায়েলি ট্যাংক।
পরিবারের বাকি সদস্যরা ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে মারা গেলেও গাজা সিটির যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে আটকে ছিল হিন্দ রজব। চাচার গাড়ির ভেতর আটকে থাকা হিন্দ ফোনকলে অনবরত সাহায্য চাইছিল রেড ক্রিসেন্ট কর্মীদের কাছে।
মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসছিল ছ'বছরের হিন্দের কণ্ঠস্বর। গাজার ছোট্ট শিশুটি ফোনকলে বলছিল, 'ট্যাংকটি খুব কাছে, আমার দিকে সরে আসছে ধীরে ধীরে।'
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের জরুরি কল সেন্টারে বসে রানা নামের সদস্য নিজ কণ্ঠস্বরকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'খুব কাছে?'
'খুব, খুব,' ছোট্ট কণ্ঠটি উত্তর দিয়েছিল। সে আরও বলেছিল, 'তুমি কি এসে আমাকে নিয়ে যাবে? আমার খুব ভয় করছে!'
ওইদিন গাজা সিটিতে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা ফেলছিল ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। চলছিল কামান ও যুদ্ধজাহাজ থেকেও গোলাবর্ষণ। ফলে শিশুটিকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করা যায়নি। ৩ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পেরেছিলেন ফিলিস্তিনি প্যারামেডিকরা।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে তারা হিন্দের চাচার কালো কিয়া পিকান্টো গাড়িটি আবিষ্কার করেন। দেখেন গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন এবং ড্যাশ বোর্ড ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বুলেটের গর্ত।
একজন প্যারামেডিক সাংবাদিকদের বলেন, গাড়ির ভেতর পাওয়া ছয়টি মৃতদেহের মধ্যে হিন্দও ছিল, সব মৃতদেহেই ছিল গুলি ও গোলার আঘাত ছিল। গাড়ির ভেতরে দেখা যাচ্ছিল শিশু হিন্দের ক্ষতবিক্ষত দেহ।
গাজায় যে বিপুল গণহত্যা চলছে, তাতে এপর্যন্ত অন্তত ১৩ হাজার ৮০০ শিশু নিহত হওয়ার কথা জানা গেছে। খাদ্যের বা চিকিৎসার অভাবে মৃত শিশুদের সংখ্যা হয়তো কখনোই আর জানা যাবে না। ম্যাকেলমোর তার গানে যেসব রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা ও শিল্পীরা গাজা যুদ্ধের কোনো প্রতিবাদ করেনি তাদের প্রতি এই মানবিক প্রশ্ন রেখেছেন:
"যদি তুমিও গাজায় থাকতে? যদি এই শিশুরা তোমার হতো? তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই তবু এই ভান যদি পশ্চিমারা করে যেত?"
অনুবাদ: নূর মাজিদ