ইসরায়েল-বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ কেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে?
গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে মেতে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে পুলিশ, পালটা বিক্ষোভকারীদেরও সংঘর্ষ হয়েছে। ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান দাবি জানাচ্ছেন তারা।
দীর্ঘ সময় পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এত তীব্র মাত্রা ধারণ করেছে। ইতিহাস বলে, প্রায় ৬০ বছর আগে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর সমর্থনে ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে প্রথম ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভ যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি লেবানন এবং ভারতেও পৌঁছেছে।
৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলিদের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলিদের হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ আন্দোলন চালাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত আড়াই হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাফায় ইসরায়েলি হামলা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছে, আরও বিক্ষোভের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার' প্রতিবাদে অনশন শুরু করেছেন কিছু শিক্ষার্থী।
কোথায় কোথায় বিক্ষোভ হচ্ছে?
নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসির প্রায় ১৪০টি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ আগে, কলাম্বিয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশের সাথে সাথে ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গাজায় নিহত ছয় বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি মেয়ের স্মরণে বিক্ষোভকারীরা হ্যামিল্টন হল দখল করে নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে আদেশ দেয়।
পরে জো বাইডেন এই বিক্ষোভ অহিংস ছিল বলে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। 'সম্পত্তি ধ্বংস করা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ নয়; এটা আইনের পরিপন্থী,' বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
বাইডেন বলেন, 'ঘৃণামূলক বক্তব্য বা সহিংসতার কোনো স্থান নেই, তা সে ইহুদিবিদ্বেষ, ইসলামোফোবিয়া বা আরব আমেরিকান বা ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যই হোক না কেন।'
এরপর থেকে যুক্তরাজ্যের প্রায় ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ শিবির স্থাপন করেছে।
নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী হালা হানিনা বলেন, 'ন্যায়বিচারের জন্য করা এ লড়াই ছাত্র সম্প্রদায় এবং ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের জন্য এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।'
প্রিন্সটনের এক ডজনেরও বেশি শিক্ষার্থী এবং এডিনবার্গের ১০ জন শিক্ষার্থী বলেছেন যে তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতির প্রতিবাদে অনশন শুরু করবেন।
এডিনবার্গের প্রিন্সিপাল ও ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর পিটার ম্যাথিসন বলেন, 'ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সম্পর্কিত ইস্যুতে তাদের অনুভূতি ও দৃঢ়তার নিদর্শন হিসেবে অজ্ঞাত সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনশন ধর্মঘট শুরু করার অভিপ্রায় সম্পর্কে আমরা অতি সম্প্রতি অবহিত হয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'যদিও আমরা তাদের অনশন করার অধিকারকে সম্মান করি কিন্তু তাদের নিজের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং সুস্থতা নিয়ে ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য আবেদন করছি। আমরা বিক্ষোভকারীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি যাতে তারা তাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার সহায়তা সম্পর্কে সচেতন হয়।
ইউরোপের দিকে কী অবস্থা?
ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি এবং স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছোট ছোট বিক্ষোভ হয়েছে, যদিও বেশিরভাগই পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সিটি হল এবং পাবলিক প্রসিকিউটরদের অনুরোধে দাঙ্গা পুলিশ মঙ্গলবার সকালে সোমবার গড়ে ওঠা একটি শিবির সরিয়ে দেয়।
তারা বিক্ষোভকারীদের তৈরি প্যালেট এবং সাইকেল দিয়ে তৈরি ব্যারিকেড সরাতে একটি যান্ত্রিক খননকারী ব্যবহার করেছিল। তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠিও ব্যবহার করেছিল এবং ১২৫ জন যারা চলে যেতে অস্বীকার করেছিল তাদের গ্রেপ্তার করে। তবে তাদের অধিকাংশকেই কয়েক ঘণ্টা পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আমরা এই যুদ্ধ নিয়ে তাদের ক্ষোভ বুঝতে পারছি এবং আমরা জোর দিয়ে বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনাই একমাত্র সমাধান।'
অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও গাজার যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত সংস্থাগুলোর শেয়ার, সম্পদ বা অন্যান্য বিনিয়োগ বিক্রি করে দেয়ার আহ্বান দিয়েছেন।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, ইসরায়েলি কোম্পানি বা ইসরায়েলে ব্যবসা করা সংস্থায় বিনিয়োগ করা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো গাজার যুদ্ধে 'সম্পৃক্ত'।
বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধবিরতি, গাজার পরিস্থিতিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি এবং গাজার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংসের নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়েছে।
কিছু শিক্ষার্থী গাজা সম্পর্কে তাদের দাবিকে জলবায়ু সংকটের সাথে যোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে, ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের ২০৩০ জলবায়ু পরিকল্পনা পূরণের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত সংস্থাগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক রিক ভ্যান ডি ওয়ালে বলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক নীতিগুলো পরিবর্তন হবে না, বিদ্যমান মানবাধিকার নীতি থেকে ইসরায়েলকে ভিন্ন চোখে দেখা হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিক্রিয়া কী?
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি গত সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের সাথে একটি চুক্তি করেছে যে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পরিচালনা পর্ষদ, কর্পোরেশন, অক্টোবরে একটি বৈঠকে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কিত সংস্থাগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে ভোটাভুটি করবে। বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্যাম্প খালি করে দেয়।
ইলিনয়ের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবং ওয়াশিংটনের অলিম্পিয়ার এভারগ্রিন স্টেট কলেজও শিক্ষার্থীদের সাথে চুক্তিতে পৌঁছেছে। অন্যদিকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের জেরে তাদের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বাতিল করেছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর নামে একটি বক্তৃতা হলের নামকরণ, ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য মানবিক বৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট স্মরণ জোটের ইহুদিবিদ্বেষের সংজ্ঞা পর্যালোচনা সহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবিতে সম্মত হওয়ার পরে লন্ডনের গোল্ডস্মিথে একটি বিক্ষোভ স্থগিত হয়।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন