নাইজেরিয়ার বিয়েতে কেন টাকা উড়ানোর রেওয়াজ! উদযাপন যে কারণে সংকট তৈরি করছে
নাইজেরিয়ান সমাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপনের বহু বছরের পুরনো একটি রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। অতিথিসহ বিয়ে বাড়ির সবাই অনুষ্ঠানের এ পর্বটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। খবর বিবিসি'র।
আর সেই রেওয়াজটি হলো বর-কনে একসঙ্গে যখন নাচ শুরু করেন, তখন গান-বাজনার তালে তালে তাদের দিকে অতিথিরা নাইরার (নাইজেরিয়ান মুদ্রা) নোট উড়িয়ে দিতে থাকেন। সেসব নোট বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে এসে জড়ো হয় মাটিতে। এই উদযাপনের মধ্য দিয়ে নতুন সংসার শুরু করার জন্য নবদম্পতিকে অর্থ দিয়ে একপ্রকারে সহযোগিতা করেন অতিথিরা।
এভাবে বাতাসে নাইরা উড়ানোকে সে দেশে বলা হয় 'স্প্রেয়িং'।
নাইজেরিয়ান সমাজে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এ রেওয়াজটি এখন হুমকির মুখে। সে দেশের সরকার এটি বন্ধ করতে চাইছে। কারণ জনপ্রিয় হলেও এটি আইন অনুযায়ী সে দেশে অপরাধ। নাইরা উড়ানোর মধ্য দিয়ে কারো ক্ষতি না হলেও দেশিয় মুদ্রার অপব্যবহার হয়।
২০০৭ সালের সেন্ট্রাল ব্যাংক অব নাইজেরিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী, 'সামাজিক কিংবা অন্য যেকোনো অনুষ্ঠানে ব্যাংকনোট স্প্রেয়িং করা অপব্যবহার হিসেবে গণ্য হবে।'
এ অপরাধের শাস্তি অন্তত ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার নাইরা অর্থদণ্ড (৩৬ মার্কিন ডলার) অথবা উভয়দণ্ড।
গত ১৭ বছর ধরে আইনটি উপেক্ষিত হয়ে এসেছে। সম্প্রতি অপরাধবিরোধী সংস্থা ইকোনমিক অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমস কমিশন (ইএফসিসি) 'সব ধরনের নাইরা অপব্যবহারের' বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, নাইরা স্প্রেয়িংয়ের কাজটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকের প্রতি অসম্মানজনক।
এ অপরাধের কারণে দেশটির বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে জেলেও যেতে হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে অভিনেত্রী ওলুওয়াদারাসিমি ওমোসেয়িনকে স্প্রেয়িংয়ের জন্য ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গত মাসে নাইজেরিয়ার জনপ্রিয় সেলিব্রিটি ববরিস্কি নামে পরিচিত এক ট্রান্সজেন্ডার নারীকেও অপব্যবহারের ঘটনায় সাজা দেওয়া হয়েছে।
এর কিছুদিন পর দেশটির এক বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী কিউবানা চিফ প্রিয়েস্টও ব্যাংকনোট অপব্যবহারের ঘটনায় অভিযুক্ত হন।
সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশজুড়ে ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২৪ জন ইতোমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
দশকের পর দশক ধরে চলে আসা রেওয়াজটি যে এভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সেটি অনেকেই কল্পনা করতে পারছেন না।
নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কানো শহরে সম্প্রতি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এক অতিথি বিবিসিকে বলেন, 'আমি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেব আর সেখানে স্প্রেয়িং করব না, সেটি কল্পনাই করতে পারি না।'
সেই বিয়ের বর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, স্প্রেয়িংয়ের ভিডিও ও ছবিগুলো তার কাছে খুবই ভালো লাগে। এজন্য তিনি সেগুলো বারবার দেখেন।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক তিজানি নানিয়া জানান, নাইজেরিয়ানদের বিয়েতে স্প্রেয়িংয়ের বিষয়টি ১৯৪০ এর দশক থেকে চলে আসছে। সে দেশের মানুষেরা এটিকে নববিবাহিত দম্পতির জন্য আর্থিক সহযোগিতার একটি উপায় হিসেবে মনে করেন। কারণ দু'জন মানুষের জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন খরচের বিষয় রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে অবশ্য এভাবে স্প্রেয়িংয়ের রীতি ছিল না। সে সময় অতিথিরা বরের কাছে গিয়ে তার পকেটে নাইরা ঢুকিয়ে দিতেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পদ্ধতি বদলেছে। এখন নববিবাহিত দম্পতির নাচের সময় আনন্দ করতে করতে তাদের দিকে নাইরা স্প্রেয়িং করা হয়।
নাইরা স্প্রেয়িং করার মাধ্যমে কেবল যে নববিবাহিত দম্পতিকে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে অতিথিরাও নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান জাহির করে থাকেন। তাই কে কত বেশি অর্থ দিতে পারলেন তা নিয়েও এক প্রকার প্রতিযোগিতা চলে।
তবে উদযাপনের এ রেওয়াজটি কেবল বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। জন্মদিনের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও এখন এটি দেখা যায়।
সম্প্রতি হাদিজা উসমান নামে এক নারীর জন্মদিনে এ রেওয়াজ দেখা যায়। হাদিজা উসমান জানান, তিনি এই রেওয়াজ ছাড়া নাইজেরিয়ান সমাজে কোনো অনুষ্ঠান কল্পনাই করতে পারেন না।
তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের বাবা-মাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাইরার নোট স্প্রেয়িং করতে দেখে বড় হয়েছি। এটি নাইজেরিয়াজুড়ে আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে।'
তবে সবাই যে এ রেওয়াজটি পছন্দ করেন, তা নয়। অনেকের কাছেই এটি অপছন্দের। এমনই একজন উসমান ইদ্রিস। তিনি কখনোই কোনো অনুষ্ঠানে এভাবে স্প্রেয়িং করেননি।
উসমান ইদ্রিস বলেন, 'আমি এই রেওয়াজটি ঘৃণা করি। কারণ এটি একটি ভ্রম তৈরি করে যে আমাদের দেশ একটি ধনী দেশ। কিন্তু আমাদের আশেপাশে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ রয়েছে।'
ওই অধ্যাপক জানান, নাইজেরিয়ানদের এ অভ্যাস সম্পূর্ণ বন্ধ করা কঠিন হবে। তবে তিনি মনে করেন, বর্তমানে সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ রেওয়াজ এমনিতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।
তিনি বলেন, 'স্প্রেয়িং করার বিষয়টি বলতে গেলে লোক দেখানো। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় অনেক লোকই এ রেওয়াজ চর্চা থেকে সরে এসেছেন।'
বিশ্লেষক সানি বালা মনে করেন, সরকারের নাইরা স্প্রেয়িং বন্ধের প্রচেষ্টায় আশানুরূপ কাজ হবে না।
তিনি বলেন, যদি এটি বন্ধ করতে হয়, তাহলে সরকারকে একদম শীর্ষ পর্যায় থেকে এটি বন্ধ করা শুরু করতে হবে। কারণ আমরা গভর্নর ও মন্ত্রীদেরও এটি করতে দেখেছি। আর দ্বিতীয়ত আমি মনে করি এখন এই পদক্ষেপ নেওয়ার সঠিক সময় নয়। কেননা বেশিরভাগ নাইজেরিয়ান এই মুহূর্তে আরও অন্যান্য সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।'
তবে সরকারের কড়াকড়িতে একেবারেই যে কাজ হচ্ছে না তা নয়। অনেকের আচরণে কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন- স্প্রে করার সময় অনেকেই ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে নিষেধ করছেন। কখনও বা তারা সবার অগোচরে বরের কাছে গিয়ে তার পকেটে অর্থ ঢুকিয়ে দিয়ে আসছেন।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক