তেলাপোকা যেভাবে পৃথিবী দখলে নিল!
তেলাপোকা। নামটি শুনলেই অনেকের গা ঘিনঘিন করে ওঠে। অনেকে একে বেজায় ভয়ও পায়। এই পতঙ্গটির বাস যাবতীয় ময়লা আবর্জনা ও অন্ধকারে। রোগ ছড়িয়ে বেড়ায়। অনায়াসেই যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে পতঙ্গটির।
তেলাপোকার উপদ্রুপ নতুন কিছু নয়। অতীতে আবাসিক ফ্ল্যাট, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল থেকে শুরু করে শহরের বাজারহাটেও দেখা যেত এক ইঞ্চি-দৈর্ঘ্যের আমেরিকান তেলাপোকা। তবে গত এক দশকে আমেরিকান তেলাপোকার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত খুবই ছোট আকারের জার্মান তেলাপোকা, যা চীনা তেলাপোকা নামেই বেশি পরিচিত তাদের সংখ্যা বেড়েছে।
গত ২০ মে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় প্রাচীন এশীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে কীভাবে এই তেলাপোকা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।
জার্মান তেলাপোকা, যাকে ব্লাটেলা জার্মানিকাও বলা হয়, নাম শুনে আপনার মনে হতে পারে এটি জার্মানির কোনো জঙ্গল থেকে এসেছে, তবে আদতে তা নয়। আজ অবধি, জনসংখ্যা কাঠামোর বাইরে কখনও পাওয়া যায়নি। বসতবাড়ি ও দালানেই এর বসবাস।
কীভাবে এই তেলাপোকা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তা জানতে ড. কিয়ান ট্যাং ও তার দল বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞদের স্থানীয় তেলাপোকার নমুনা পাঠাতে বলেন।
১৭টি দেশ ও ছয়টি মহাদেশের ২৮০টিরও বেশি নমুনার জিনোমিক বিশ্লেষণ করে গবেষক দলটি জানান, এই প্রজাতিটি প্রায় ২,১০০ বছর আগে ব্লাটেলা আসাহিনাই নামে পরিচিত বন্য এশিয়ান তেলাপোকা থেকে বিবর্তিত হয়েছিল। মানুষের সাথে ভ্রমণ করে এরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।
কলেজ অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের কীটতত্ত্ব বিভাগের নগর কীটতত্ত্বের সহযোগী অধ্যাপক ওয়ারেন বুথের মতে, জার্মান তেলাপোকা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ। এগুলো রোগ ছড়াতে পারে, খাবারকে দূষিত করতে পারে এবং হাঁপানি এবং অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
ড. ট্যাং ও তার দল মনে করেন, প্রায় ২১০০ বছর আগে বর্তমান ভারত বা মিয়ানমারের মানুষ এই তেলাপোকার প্রাকৃতিক আবাসস্থলে চাষাবাদ শুরু করেন। তেলাপোকার লার্ভা শস্যের মাধ্যমে মানুষের জীবনচক্রে ঢুকে পড়ে।
প্রায় এক হাজার বছর পর দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য ও সামরিক তৎপরতা বাড়তে থাকলে এসব তেলাপোকা ধীরে ধীরে পশ্চিমা দেশগুলোর দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত ভ্রমণকৃত সৈন্যদের খাদ্যের সাথেই তেলাপোকা পশ্চিমে চলে আসে।
গবেষক দলের করা জিনগত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় ২৭০ বছর আগে এই তেলাপোকা প্রথম ইউরোপে প্রবেশ করে। এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা জুড়ে সাত বছরের যুদ্ধ চলার প্রায় এক দশক পর ১৭৭৬ সালে বিখ্যাত সুইডিশ জিনতত্ত্ববিদ কার্ল লিনিয়াস প্রথম এই তেলাপোকার ধারণা ও বর্ণনা দেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রায় ১২০ বছর আগে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমায় এই কীট।
নিউ ইয়র্ক সিটির আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির কিউরেটর ড. জেসিকা ওয়ার বলেন, 'কীটপতঙ্গ মানব সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা জানি যে মানুষের সংস্পর্শে এসে কীটপতঙ্গ প্রজাতি ছড়িয়ে পড়ে। তবে আমরা ধারণা করতাম যে হয়ত ট্রান্সআটলান্টিক বাণিজ্য পথের মাধ্যমে জার্মান তেলাপোকা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে তাদের জিনগত বিশ্লেষণের পর দেখলাম আমাদের ধারণাই সত্যি।'
ড. ট্যাং জানান তিনি ও তার দল এরপরে জার্মান তেলাপোকার সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্স পরীক্ষা করতে চান, জার্মান তেলাপোকা কীভাবে মানব পরিবেশের সাথে এত সফলভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে তা উদ্ঘাটন করতে।
তিনি বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, জার্মান তেলাপোকার কীটনাশক প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে যা অন্যান্য অনেক কীটপতঙ্গের মধ্যে দেখা যায় না। কীভাবে তারা এত দ্রুত বিকশিত হতে পেরেছে? এটি কি তাদের জিনগত কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে, নাকি অন্য কিছু?'
ট্যাং আরও জানান, এই তেলাপোকা সামাজিক আচরণও প্রদর্শন করে, যেমন খাবার খোঁজার জন্য অন্য তেলাপোকার সাথে যোগাযোগ করে থাকে এটি। এটি মানুষের কাছাকাছি থাকার মাধ্যমে বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে যোগাযোগের ক্ষমতা অর্জন করেছে কিনা, তাও খুঁজে বের করতে চান বলে জানান ড. ট্যাং।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন