ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কি ট্রাম্প নির্বাচন করতে পারবেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে পর্ন তারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে টাকা দেওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নথিপত্রে তথ্য গোপন করার অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন নিউইয়র্কের একটি আদালতের জুরিদল। খবর বিবিসির।
দুইদিন শুনানির পর ১২ সদস্যের জুরিদল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। জুরিদলের প্রত্যেকেই তাকে দোষী বলে রায় দিয়েছেন।
রায়ের সময় ট্রাম্প আদালতেই উপস্থিত ছিলেন। দোষী সাব্যস্ত করার রায় ঘোষণার সময় তিনি নিরাসক্তভাবে জুরিদের দেখছিলেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়া ট্রাম্পের ভাগ্যে এখন কী রয়েছে।
ট্রাম্প কী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কেননা মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের জন্য যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সবই ট্রাম্প প্রার্থী হিসেবে পূরণ করেন। যেমন, তাদের কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে, জন্মগতভাবে মার্কিন নাগরিক হতে হবে এবং কমপক্ষে ১৪ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। এক্ষেত্রে অপরাধমূলক রেকর্ডের কারণে প্রার্থী হতে না পারার নিয়ম দেশটির সংবিধানে নেই।
তবে ট্রাম্পের এই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায় নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গ এবং মর্নিং কনসাল্টের একটি জরিপে দেখা যায়, মূল দোদুল্যমান স্টেটের ৫৩ ভাগ ভোটার ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ভোট না দিতে পারে।
চলতি মাসে কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পের পক্ষের ৬ ভাগ ভোটারেরও তাকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই ধরনের প্রভাব নির্বাচনকে আরও কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে নিয়ে যাবে।
ট্রাম্পের এখন কী হবে?
ট্রাম্প বিচার চলাকালীন জামিনে মুক্ত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার দোষী সাব্যস্তের পরেও তাকে জেলে পাঠানো হয়নি। আগামী ১১ জুলাই এই রিপাবলিকান আদালতে ফিরে আসবেন। সেদিন বিচারপতি জুয়ান মার্চান সাজা শুনানির জন্য নির্ধারিত করেছেন।
বিচারককে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বয়সসহ বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনা হতে পারে। এক্ষেত্রে শাস্তির মধ্যে জরিমানা, প্রবেশন বা তত্ত্বাবধান এমনকি জেলেও পাঠানো হতে পারে।
ট্রাম্প অবশ্য রায়টিকে 'অসম্মানজনক' বলে অভিহিত করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চিতভাবেই তিনি এই দোষী সাব্যস্ত হওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। এই আপিল নিষ্পত্তি হতে কয়েক মাস কিংবা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
অর্থাৎ, সাজা ঘোষণার পরেও ট্রাম্প আদালত থেকে হাতকড়ায় পরে জেলে যাচ্ছেন, এমন চিত্র খুব সহজেই হয়তো দেখা যাবেনা। কেননা আপিলের সময়টাতে তিনি জামিনে মুক্ত থাকবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আপিল করার ক্ষেত্রে যুক্তি কী হবে?
পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের দাখিলকৃত প্রমাণ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলার মূল বিষয়বস্তু ছিল। এটি আবার আপিলের ক্ষেত্রে একটি কারণ হতে পারে।
যেমন, নিউইয়র্ক ল স্কুলের অধ্যাপক আনা কমিনস্কি বলেন, "(ড্যানিয়েলস) যে ধাঁচে বিশদ বিবরণ সরবরাহ করেছেন তা আসলে ঘটনাটি তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় নয়।"
কমিনস্কি আরও বলেন, "অন্যদিকে ড্যানিয়েলসের বিশদ বিবরণটি তার অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। একজন প্রসিকিউটর হিসাবে সকলেই পর্যাপ্ত বিশদ বিবরণ সরবরাহ করতে চান যাতে বিচারক তার কথা বিশ্বাস করেন। তবে এই বিবরণের একটি সীমা আছে, যেটি পার হলে তখন তা অপ্রাসঙ্গিক ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠতে পারে।"
ড্যানিয়েলসের সাক্ষ্যের সময় ট্রাম্পের ডিফেন্স টিম দুবার বিচারকে প্রভাবিত করার দাবি তুলেছিলেন। যদিও বিচারকদের পক্ষ থেকে তা আমলে নেওয়া হয়নি। এছাড়াও ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি যে অভিনব আইনি কৌশল নিয়েছেন তা আপিলের জন্য ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতি করা নিউইয়র্কে মারাত্মক গুরুতর কোনো অপরাধ নয়। তবে ২০১৬ সালে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার যে অভিযোগ, সেটি তাকে বিপদে ফেলতে পারে।
মামলার প্রসিকিউটরদের অভিযোগের পাল্লায় রয়েছে ফেডারেল ও স্টেট নির্বাচনে আইনের লঙ্ঘন, ট্যাক্স জালিয়াতি ইত্যাদি। কিন্তু তারা বিচারকদের কাছে নির্দিষ্ট করে বলেননি যে কোন আইনটি ভাঙ্গা হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ফেডারেল আইনের সুযোগ ও প্রয়োগে প্রশ্ন করার ক্ষেত্র রয়েছে। যা আপিলের জন্য একটি যুক্তি তৈরি করতে পারে। এর আগে কখনও কোনও রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউটর চার্জ না করা ফেডারেল অপরাধের জন্য আবেদন করেননি। সেক্ষেত্রে ম্যানহাটন জেলা অ্যাটর্নির এটি করার এখতিয়ার ছিল কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৬ সালে পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। ওই সময় বর্তমান স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে ছিলেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যাতে তাদের এই সম্পর্ক ফাঁস না হয়ে যায়, সেজন্য ওই পর্নতারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ওই অর্থ দেওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক নথিপত্রেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। ট্রাম্প অবশ্য এই পর্নতারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কথা অস্বীকার করেছেন।
পরে আদালতে যান স্টর্মি ড্যানিয়েলস। ট্রাম্পের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্কের বিবরণ থেকে শুরু করে ঘুষের কথা জানান তিনি।
ছয় সপ্তাহ ধরে চলা বিচার শেষে, দুদিন আলোচনার পর মামলার রায় দেন জুরিরা। এর আগে জুরিরা ৬ সপ্তাহ ধরে ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শুনেছেন।
সব সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পর জুরিরা সর্বসম্মতভাবে ট্রাম্পকে দোষী বলে রায় দেন।
পর্নতারকাকে ঘুষ দেওয়া ছাড়াও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বদলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের মামলা চলছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষের পর হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি গোপন নথিপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে আরও একটি মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান