এমআইটি গবেষকদের আবিষ্কার: বাড়িকেই দৈত্যাকার ব্যাটারিতে পরিণত করবে যে সিমেন্ট, জোগাবে বিদ্যুৎ
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরণ সম্ভবত কংক্রিট। তবে সামান্য একটু 'কেরামতি' খাটিয়ে নিলেও কংক্রিট আপনার ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহেও সাহায্য করতে পারবে। খবর বিবিসির।
ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজের এক গবেষণাগারে গেলে দেখা মিলবে কালো কংক্রিটের একগাদা চকচকে সিলিন্ডার স্নান করছে তরল ও তারের জঙ্গলের মধ্যে। সাদা চোখে এ দৃশ্যের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু ডেনিয়েল স্টেফানিউক একটি সুইচ টিপলেই আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। ওই সিমেন্টের ব্লকগুলোর সঙ্গে একটি এলইডি বাতির সংযোগ দেওয়া হয়েছে তারের মাধ্যমে। আর সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠবে সেই বাতি।
সেই এলইডি বাতি জ্বালানোর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে স্টেফানিউক বলেন, 'প্রথমে আমার বিশ্বাসই হয়নি। ভেবেছিলাম, বিদ্যুতের বাহ্যিক উৎসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিনি, সেজন্যই এলইডি জ্বলছে।
'এক অসাধারণ দিন ছিল সেটা। শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানালাম, প্রফেসরদেরও, কারণ প্রথমে তারাও কেউ বিশ্বাস করেননি যে এটা কাজ করে।'
এত উত্তেজনার কারণ? এই নিরীহ চেহারার, কালো কংক্রিটের দলাই হয়তো ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে শক্তির ভান্ডার।
সবচেয়ে বেশি পরিচ্ছন্ন শক্তি পাওয়া যায় সূর্য, বাতাস ও সাগর থেকে।
কিন্তু সূর্য সবসময় ওঠে না, বাতাসও সবসময় প্রবাহিত হয় না, আর পানি যখন স্থির থাকে তখনও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না। এসব শক্তির উৎস মাঝে মাঝেই বাধাগ্রস্ত হয়—যা আধুনিক দুনিয়ার জন্য একটা সমস্যাই বটে।
এ সমস্যার অর্থ হচ্ছে, এসব শক্তি ব্যাটারিতে মজুত করে রাখতে হবে। কিন্তু ব্যাটারি আবার লিথিয়ামের মতো ধাতুর ওপর নির্ভরশীল, যার সরবরাহ চাহিদার তুলনায় খুব কম। সারা দুনিয়ায় লিথিয়ামের খনি আছে ১০১টি। এসব খনি বৈশ্বিক চাহিদা কতটুকু মেটাতে পারবে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকরা। এছাড়া লিথিয়াম উত্তোলন করতেও প্রচুর শক্তি ও পানি লাগে। তাছাড়া এ প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে স্থানীয় পানি সরবরাহের উৎসেও রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লিথিয়াম সরবরাহের অপ্রতুলতা এবং পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ব্যাটারি তৈরির বিকল্প উপকরণের সন্ধানে আছেন গবেষকরা।
আর এই সমস্যার সমাধানেই চলে আসছে স্টেফানিউক আর তার কংক্রিটের নাম। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলজির (এমআইটি) সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তিনি সুপারক্যাপাসিটর নামে পরিচিত এক শক্তি মজুতের ডিভাইস তৈরি করেছেন। ডিভাইসটি বানানো হয়েছে তিনটি সহজপ্রাপ্য, সস্তা জিনিস দিয়ে—পানি, সিমেন্ট ও ঝুল-সদৃশ কার্বন ব্ল্যাক।
সুপারক্যাপাসিটর শক্তি ধরে রাখতে অত্যন্ত দক্ষ, তবে ব্যাটারির সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য আছে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির চেয়ে অনেক দ্রুত চার্জ হয় সুপারক্যাপাসিটর, আর কার্যক্ষমতাও এত কমে না। তবে সুপারক্যাপাসিটর তার মধ্যে ধরে রাখা শক্তি দ্রুত ছেড়েও দেয়। এ কারণে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা গাড়িতে এরা খুব একটা কাজে আসে না। এসব ডিভাইসে বেশ অনেকক্ষণ ধরে নিয়মিত স্থিরভাবে শক্তি সরবরাহ প্রয়োজন হয়।
তবু স্টেফানিউকের মতে, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে কার্বনমুক্তকরণের প্রচেষ্টায় কার্বন-সিমেন্ট সুপারক্যাপাসিটর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, উন্নত করা গেলে এ প্রযুক্তি নবায়নযোগ্য শক্তি মজুত করে রাখার সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতে পারে।
এমআইটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ওয়াইস ইন্সটিটিউট ফর বায়োলজিক্যালি ইনস্পায়ারড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্টেফানিউকের দল তাদের এই সুপারক্যাপাসিটরকে বেশ কয়েকটি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছেন।
তাদে একটি পরিকল্পনা হচ্ছে সৌরশক্তি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে, এমন সড়ক তৈরি করা। তারপর সেই মজুত করে রাখা শক্তি দিয়ে ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করা বৈদ্যুতিক গাড়িকে (ইভি) ওয়্যারলেস পদ্ধতিতে চার্জ করা। কার্বন-সিমেন্ট সুপারক্যাপাসিটর থেকে দ্রুতগতিতে মুক্তি পাওয়া শক্তি দিয়ে ইভির ব্যাটারিও দ্রুত চার্জ হয়ে যাবে।
আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে, শক্তি মজুত করে রাখতে সক্ষম বাড়ির ভিত (ফাউন্ডেশন) তৈরি। স্টেফানিউক বলেন, এমন দেয়াল বা ভিত কিংবা কলাম বানানো যা শুধু অবকাঠামোটিকে দাঁড়িয়ে থাকতেই সহায়তা করবে না, বরং নিজের মধ্যে শক্তিও সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে।
তবে তাদের গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আপাতত তাদের কংক্রিটের সুপারক্যাপাসিটর প্রতি ঘনমিটারে ৩০০ ওয়াট-ঘণ্টা শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে। এ শক্তি দিয়ে ১০ ওয়াটের একটি এলইডি বাতি ৩০ ঘণ্টা জ্বালানো যাবে।
স্টেফানিউক বলেন, প্রথাগত ব্যাটারির তুলনায় এ ক্যাপাসিটরে আউটপুট কম পাওয়া যায় বলে মনে হতে পারে। তবে ৩০-৪০ ঘনমিটারের একটি ভিত একটি আবাসিক বাড়ির দৈনিক শক্তির চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হবে।
'বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ কংক্রিট ব্যবহার হয়, তাতে শক্তি সংরক্ষণে এই জিনিসের অত্যন্ত প্রতিযোগিতা-সক্ষম এবং উপকারী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,' বলেন তিনি।
স্টেফানিউক ও তার এমআইটির সহকর্মীরা সেন্ট-সাইজের ১ ভোল্টের সুপারক্যাপাসিটর বানিয়ে এ ধারণার সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছেন। এসব সুপারক্যাপাসিটর দিয়ে তারা ৩ ভোল্টের এলইডি বাতি জ্বালিয়েছেন। এরপর তারা পরিসর বাড়িয়ে ১২ ভোল্টের সুপারক্যাপাসিটর বানিয়েছেন। স্টেফানিউক আরও বড় সুপারক্যাপাসিটর দিয়ে গেমস কনসোল চালু করতে পেরেছেন।
গবেষণাদলটি এখন ৪৫ ঘনমিটারসহ আরও বড় আকারের সুপারক্যাপাসিটর বানানোর পরিকল্পনা করছে। ৪৫ ঘনমিটারের সুপারক্যাপাসিটরে ১০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা শক্তি সংরক্ষণ করা যাবে, যা দিয়ে একটি বাড়িতে সারাদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।
কার্বন ব্ল্যাকের এক অস্বাভাবিক গুণের জন্য কাজ করে এই সুপারক্যাপাসিটর। কার্বন ব্ল্যাক অত্যন্ত পরিবাহী, অর্থাৎ এর সঞ্চালন ক্ষমতা অনেক বেশি। এর অর্থ, কার্বন ব্ল্যাককে যখন সিমেন্টের গুঁড়া ও পানির সঙ্গে মেশানো হয়, তখন এটি পরিবাহী পদার্থে ভরপুর কংক্রিট তৈরি করে। ওই কংক্রিট হয়ে ওঠে অজস্র শাখা-প্রশাখা বিস্তারকারী ছোট ছোট শেকড়ের মতো।
দুটি পরিবাহী প্লেট দিয়ে ক্যাপাসিটর বানানো হয়। প্লেট দুটোর মাঝখানে থাকে একটি ঝিল্লী। এক্ষেত্রে উভয় প্লেটই কার্বন ব্ল্যাক সিমেন্টের তৈরি হয়, যা পটাসিয়াম ক্লোরাইড নামক ইলেক্ট্রোলাইট লবণে চুবিয়ে নেওয়া হয়।
লবণে ভেজানো প্লেটে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিলেই ধনাত্মক আধানযুক্ত (চার্জযুক্ত) প্লেট পটাসিয়াম ক্লোরাইড থেকে ঋণাত্মক আধানযুক্ত আয়ন সংগ্রহ করে। আর মাঝখানের ঝিল্লী বা পর্দা আধানযুক্ত আয়নকে দুপাশের প্লেটে বিনিময় হওয়া থেকে বিরত রাখে। আধানগুলো আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র (ইলেকট্রিক ফিল্ড) তৈরি হয়।
সুপারক্যাপাসিটর বিপুল পরিমাণ আধান অত্যন্ত দ্রুত জমা করতে পারে। ফলে এটি বায়ু ও সৌরশক্তির মতো মাঝে মাঝে বাধাপ্রাপ্ত উৎসগুলোর সৃষ্ট বাড়তি শক্তিকে সংরক্ষণ করতে রাখতে ডিভাইসগুলোকে কার্যকর করে তুলতে পারে। এর ফলে যখন বায়প্রবাহ ও সূর্যের আলো থাকবে না, তখন গ্রিডের ওপর চাপ কমবে।
স্টেফানিউক বলেন, একটি সহজ উদাহরণ হবে সোলার প্যানেল দিয়ে চালিত একটি অফ-গ্রিড বাড়ি। এ বাড়িতে দিনের বেলায় সরাসরি সূর্যের আলো থেকে পাওয়া সৌরশক্তি ব্যবহার করা যাবে, আবার ফাউন্ডেশনে মজুত করে রাখা শক্তি ব্যবহার করা যাবে রাতের বেলায়।
সুপারক্যাপাসিটর নিখুঁত নয়। বিদ্যমান সংস্করণগুলো দ্রুত জমিয়ে রাখা শক্তি ছেড়ে দেয়—এবং একটি বাড়িতে সারাদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়ার জন্য দরকারি স্থির আউটপুটের জন্যও আদর্শ নয়।
স্টেফানিউক বলেন, তার দল এ সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। তবে চূড়ান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা সেরে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের আগে তারা বিস্তারিত কিছু জানাবেন না।
এছাড়া আরও কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে হতে পারে। যেমন, বেশি কার্বন ব্ল্যাক যোগ করলে সুপারক্যাপাসিটর বেশি শক্তি মজুত করতে পারে, কিন্তু এতে কংক্রিটও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। গবেষকরা বলছেন, একাধারে অবকাঠামো দাঁড় করিয়ে রাখতে এবং শক্তি সঞ্চয়ে ভূমিকা রাখার জন্য কার্বন ব্ল্যাকের সর্বোত্তম মিশ্রণ কেমন হতে পারে, তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
এছাড়া কার্বন-সিমেন্ট সুপারক্যাপাসিটর লিথিয়ামের ওপর আমাদের নির্ভরতা কমালেও পরিবেশের এরও প্রভাব রয়েছে। মানব-কার্যক্রমের ফলে বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণের ৫-৮ শতাংশের জন্য দায়ী সিমেন্টের উৎপাদন। আর সুপারক্যাপাসিটরের জন্য যে কার্বন-সিমেন্ট লাগবে, তা একেবারে নতুনভাবে তৈরি করতে হবে।
তবে এ আবিষ্কারকে প্রতিশ্রুতিশীল মনে করছেন যুক্তরাজ্যের টিসিডি ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রধান মাইকেল শর্ট। তিনি বলেন, এ গবেষণা অনেক আকর্ষণীয় সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। 'যেহেতু উপাদানগুলো সর্বত্র পাওয়া যায় এবং উৎপাদনও তুলনামূলক সরল, তাই এই পদ্ধতি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন এবং এটি আরও পরিচ্ছন্ন, টেকসই ভবিষ্যতের অত্যন্ত কার্যকরী অংশ হতে পারে।'
তবে এ পদ্ধতিকে গবেষণাগার থেকে বাস্তব দুনিয়ায় নিয়ে আসার জন্য আরও গবেষণা করতে হবে।
তবে পরিবেশ-অবান্ধব সিমেন্টের সমস্যা সমাধানের উপায় থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন শর্ট। টিসিডি ইউনিভার্সিটির সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তিনিও কম কার্বন নিঃসরণ করবে এমন সিমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন। এ সিমেন্ট তৈরি হবে ইস্পাত ও কেমিক্যাল শিল্পের বাইপ্রোডাক্ট থেকে।