বিভ্রান্ত মস্তিষ্ক, বিকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হার্টের অতিরিক্ত খাটুনি: গরম যেভাবে বিপদ বাড়ায়
যখন বাইরে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়, মানবদেহ গুরুতর ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। কখনও কখনও এটি জীবন-মৃত্যুর পরিস্থিতিও হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপজনিত অসুস্থতা এবং মৃত্যু আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে। হট বক্সে (নিয়ন্ত্রিত গরম পরিবেশে) মানুষের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা আগের থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপ মানবদেহে কীভাবে প্রভাব ফেলে— সেটির ব্যাখ্যাই বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) কাছে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা
মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যাপক অলি জে-এর মতে, মাত্র ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষের হিটস্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
হিউস্টন মেথোডিস্ট হাসপাতালের জরুরি ওষুধ বিভাগের পরিচালক ডা. নীল গান্ধী বলেছেন, তাপপ্রবাহের সময় সংক্রমণ ছাড়াই ১০২ ডিগ্রি বা তার বেশি জ্বর থাকলে তাপজনিত ক্লান্তি বা হিটস্ট্রোকের পরীক্ষা করা হয়।
তিনি বলেন, তাপপ্রবাহের সময় কারো শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রিতে পৌঁছাতে দেখা যায়। এর থেকে কয়েক ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে।
তাপজনিত কারণে কীভাবে মৃত্যু ঘটে?
অলি জে এর মতে মূলত তিন ধরনের তাপজনিত ঘটনায় বা রোগে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।
হিটস্ট্রোক: যখন শরীরের তাপমাত্রা গুরুতরভাবে বেড়ে যায় তখন হিটস্ট্রোক হতে পারে এবং এর ফলে মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
শরীরের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে, শরীরকে ঠান্ডা করতে ত্বকে রক্ত পাম্প করা হয়। কিন্তু এর ফলে পাকস্থলী এবং অন্ত্রে রক্ত এবং অক্সিজেন কমে যায় যা রক্তে বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে দিতে পারে।
অলি জে এর মতে, হিটস্ট্রোক এর কারণে মানবদেহে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, একাধিক অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
হার্ট স্ট্রেন: অলি জে এর মতে, তাপজনিত কারণে সব থেকে বেশী মৃত্যু ঘটে হার্ট স্ট্রেন থেকে। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই হার্টের সমস্যা (হৃদরোগ) আছে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
হার্ট স্ট্রেন ঘটলে হার্ট (হৃৎপিণ্ড) শরীরকে ঠান্ডা রাখতে ত্বকে রক্ত পাম্প করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে, যা রক্তচাপ কমায়। কিন্তু এতে হৃৎপিন্ডের ওপর প্রচণ্ড চাপ পরে। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই অতিরিক্ত স্ট্রেন মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা): প্রচণ্ড তাপের কারণে এবং আর্দ্রতা বেশি থাকলে মানবদেহে অতিরিক্ত ঘাম হয় যা থেকে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। অলি জে জানিয়েছেন, এর ফলে কিডনির ক্ষতি হয় এবং সম্ভাব্যভাবে অঙ্গটি বিকল হয়ে যেতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রেনি সালাস বলেন, পানিশূন্যতার জন্য দেহে রক্ত, অক্সিজেন ও পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব দেখা দেয় যা থেকে অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি ওঠা এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
বিশেষত যেসব ব্যক্তি অন্য কোন রোগের জন্য চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেনা বা যারা নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করছেন— তাদের জন্য পানিশূন্যতা সব থেকে বড় ঝুঁকি বলে জনাইয়েছেন রেনি সালাস।
অলি জে বলেছেন, পানিশূন্যতা দেহের রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়ায় সেটি হৃদরোগের সমস্যাকে আরও জটিল করে দিতে পারে।
মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করা
তাপ মস্তিষ্ককেও প্রভাবিত করে বিভ্রান্তি বা চিন্তাভাবনার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে বেশ কয়েকজন ডাক্তার জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিষয়ক অধ্যাপক ক্রিস ইবি বলেছেন, বিভ্রান্তি তাপজনিত সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণগুলোর একটি।
তিনি বলেন, এই লক্ষনটি অনেকেই সহজে শনাক্ত করতে পারে না, বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিরা এটি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিজিওলজির অধ্যাপক ডব্লিউ. ল্যারি কেনি বলেন, হিটস্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ হলো: ১০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস শরীরের তাপমাত্রা এবং কগনিটিভ ডিসফাংকশন (মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়া কিংবা দেহের মোটর কার্যকারিতা কমে আসা)।
আর্দ্রতার প্রভাব
বিজ্ঞানীরা ওয়েট-বাল্ব গ্লোব তাপমাত্রা নামের একটি পরিমাপ ব্যবহার করে যেটি তাপজনিত বিপদ, আর্দ্রতা, সৌর বিকিরণ এবং বাতাসের ওপর নির্ভর করে।
পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ডব্লিউ ল্যারি কেনি বলেন, আগে ওয়েট-বাল্ব রিডিংয়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখালে সেটিকে মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হত। কিন্তু বর্তমানে পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, রিডিংয়ে তাপমাত্রা ৩০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখালেই সেটি বিপজ্জনক।
কেনি জানিয়েছেন, এটি মধ্যপ্রাচ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে। তবে তরুণদের জন্য ৩০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়া তাপমাত্রা বিপজ্জনক হলেও বয়স্কদের ক্ষেত্রে রিডিং ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখালেই বিভিন্ন তাপজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, "শুষ্ক তাপপ্রবাহের থেকে আর্দ্রতাযুক্ত তাপপ্রবাহে অধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে।"
কেনি শুষ্ক তাপমাত্রায় অল্পবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের পরীক্ষা করে দেখেছে, তরুণরা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়া তাপমাত্রা পর্যন্ত কাজ করতে পারলেও বয়স্করা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে আর কাজ করতে পারে না। উচ্চ বা মাঝারি আর্দ্রতা আছে— এমন পরিস্থিতিতে তরুণ কিংবা বয়স্কদের কেউই প্রায় উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করতে পারেনি।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অলি জে বলেন, আর্দ্রতা ঘামের বাষ্পীভবনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করায় শরীরকে ঠান্ডা রাখা কঠিন হয়ে পরে।
রোগীদের দ্রুত ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করা
কোনো ব্যক্তি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে জরুরি চিকিৎসা দিতে হয়।
ডা. রেনি সালাস বলেন, চিকিৎসকসহ চিকিৎসার সাথে জড়িত কর্মীরা ৩০ মিনিটের মধ্যে একজন হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, রোগীকে ঠান্ডা করার সব থেকে ভালো উপায় তাকে ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখা।
কিন্তু রোগীকে চুবানোর মত ব্যবস্থা না থাকলে রোগীদের শিরায় ঠান্ডা তরল পাম্প করা হয় কিংবা শরীরে পানি স্প্রে করা হয়। অনেক সময় রোগীর বগলে এবং কুঁচকিতে বরফের প্যাক লাগান হয় কিংবা ঠান্ডা পানি দিয়ে ভেজানো মাদুরের ওপর রাখা হয়।
কিন্তু কখনও কখনও এগুলো রোগীর ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে।
ড. সালাস জানিয়েছেন, হিটস্ট্রোক নীরব ঘাতক কারণ এটির লক্ষণ খুব উল্লেখযোগ্য না হওয়ায় শনাক্ত করা কঠিন।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়