অস্ট্রেলিয়া অ্যাসাঞ্জের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু সময়ে তারও পরিবর্তন হয়েছে
দীর্ঘ ১৪ বছর পর জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রেখেছেন আলোচিত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। বিমান থেকে নেমে তার হাত উঁচিয়ে হয়ত নিজের বিজয়ের জানান দেওয়ার কিংবা স্ত্রীর সাথে আবেগীয় মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। বিমানঘাঁটি থেকে বের হওয়ার সময় অল্প সংখ্যক সমর্থকও তাকে সাদরে অভিবাদন জানিয়েছে। খবর বিবিসির।
তবে অ্যাসাঞ্জের ঘটনার ব্যাপকতা অনুসারে এটা যে খুব জমকালো প্রত্যাবর্তন তা কিন্তু নয়। অজস্র মানুষ তাকে বরণের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলেন এমনটাও হয়নি। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে দেশটির সরকার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে।
অ্যাসাঞ্জের প্রত্যাবর্তনের সময় ক্যামেরার অন্তরালে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত। একইসাথে সেখানে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার হাই কমিশনার স্টিফেন স্মিথ। যিনি কি-না ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
অন্যদিকে অ্যাসাঞ্জ দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী এন্থনি আলবানিস তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "চলমান ঘটনাপ্রবাহের অবসান হওয়ায় আমি বেশ খুশি। আজ রাতে অ্যাসাঞ্জকে দেশে স্বাগত জানাতে পেরে আমি উচ্ছ্বাসিত।"
তবে ২০১০ সালে পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। কেননা ঐ সময়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন অ্যাসাঞ্জ।
তখন উইকিলিকস আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার গোপন নথি প্রকাশ করেছিল। সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার মতো স্পর্শকাতর সব ফুটেজও ছিল। এতে করে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় ওয়াশিংটন।
এর কিছুদিন পর থেকেই সুইডিশ কর্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে দুই নারীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে আনে। যদিও উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা এটিকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ বলে অভিহিত করেছেন।
এদিকে প্রথম দিকে নিজ দেশের সরকারের পক্ষ থেকে খুব একটা সহযোগিতা অ্যাসাঞ্জ পাননি। এক্ষেত্রে তিনি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে 'বিশ্বাসঘাতকতার' অভিযোগ করেছিলেন।
এই বিষয়ে জুলিয়া গিলাদ বলেছিলেন, "আসুন আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কোনো অতিরঞ্জন না করি। বেআইনি কাজ ছাড়া তথ্যগুলো উইকিলিকসের কাছে আসতো না।"
এক্ষেত্রে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়া সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাসাঞ্জের প্রতি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করা হয়নি। বরং তারা মার্কিন কর্তৃপক্ষকে সকল ধরনের সহযোগিতা করেছে।
পাশাপাশি উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা দেশটির কোনো আইন ভঙ্গ করেছে কি-না সেটি যাচাইয়ে মাঠে নামে অস্ট্রেলিয়া সরকার। এক্ষেত্রে তাদের ভাবমূর্তি অনেকটা এমন ছিল যে, "আমাদের কিছু করার নেই কিংবা কিছু করা উচিতও হবে না।"
এদিকে অ্যাসাঞ্জ সুইডেনের আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর চক্রান্ত বলে অভিযোগ করেন। তাই গ্রেফতার এড়াতে তিনি লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নেন। যেখানে তিনি প্রায় সাত বছর অবস্থান করেন।
এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে অ্যাসাঞ্জকে দূতাবাস থেকে বের হতে বাধ্য করা হয়। একইসাথে তাকে বন্দিও করা হয়।
এদিকে মামলা চলাকালে অ্যাসাঞ্জের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তখন অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক মহলে তার মুক্তির জন্য সমর্থন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তখনও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এক্ষেত্রে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অ্যাসাঞ্জের মুক্তি নিয়ে কথা বলেন স্কট মরিসন। একইসাথে অভিনেত্রী পামেলা অ্যান্ডারসন ২০১৮ সালে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতার পক্ষে লবিং করতে সফর করেছিলেন।
মরিসন স্থানীয় এক রেডিও স্টেশনকে বলেছিলেন, "আমার প্রচুর সহকর্মী রয়েছেন যারা সমস্যাটি সমাধানে পামেলা অ্যান্ডারসনের সাথে বিশেষ দূত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।"
এদিকে ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন লেবার পার্টির অ্যান্থনি আলবানিজ। তখন অ্যাসাঞ্জের সমর্থকেরা অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিল।
এক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে প্রমাণ দুর্বল হয়ে গিয়েছে বলে সুইডিশ প্রসিকিউটররা অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণের তদন্ত বাদ দিয়ে দেয়। অন্যদিকে নানা ডকুমেন্টারিতে অ্যাসাঞ্জের নথি ফাঁসের ঘটনাকে গ্ল্যামারাইজ করা শুরু হয়। সেখানে তাকে সত্যের জন্য একজন সাহসী প্রচারক বলে অভিহিত করা হয়। পাশাপাশি কারাগারে তার অসুস্থতার বিষয়টিও সামনে আনা হয়।
এক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে অ্যাসাঞ্জের প্রতি জাতীয় বিদ্বেষ করুণায় পরিণত হয়। চলতি মাসের শুরুর দিকে এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৭১ ভাগ অস্ট্রেলিয়ান মনে করেন, অ্যাসাঞ্জের মামলা বন্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে চাপ দেওয়া উচিত।
এদিকে আলবানিজকেও অ্যাসাঞ্জের মিত্র হিসাবে দেখা হয়। কেননা তিনি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন যে, অ্যাসাঞ্জের অনেক কাজকে সমর্থন না করলেও তিনি তার মুক্তির পক্ষে আছেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরেও আলবানিজ তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু সাথে জোর দিয়ে এও বলেন যে, "সব বৈদেশিক বিষয় উচ্চবাচ্য করে সমাধান করা যায় না।"
আর সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউএস স্টাডিজের অনারারি প্রফেসর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাইমন জ্যাকম্যান মনে করেন, অ্যাসাঞ্জের অনেক সমর্থক অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমান সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনের মধ্যকার সেতুবন্ধনকে সুযোগ হিসেবে বিশ্বাস করেছিল।
গত বছরের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরে আলবানিজ অ্যাসাঞ্জের কথা সরাসরি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে উত্থাপন করেছিলেন। একইসাথে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট অ্যাসাঞ্জকে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানায়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগ এবং পরবর্তীতে বাইডেন প্রশাসনের জন্য 'সমস্যাজনক' বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। বিবিসিকে এমনটাই জানিয়েছেন সিআইএর সাবেক চিফ অফ স্টাফ ল্যারি ফিফার। এছাড়াও মামলাটি সমাধানে অস্ট্রেলিয়ার ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেও চাপ ছিল।
ফিফার বলেন, "তবে সমস্যাটি সমাধানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা অস্ট্রেলিয়ার। কূটনীতি যে কতটা ভালোভাবে কাজ করতে পারে এটা তার প্রমাণ।"
এদিকে সম্প্রতি স্ত্রী স্টেলা বলেছেন যে, "মানুষ অ্যাসাঞ্জকে ভিন্নভাবে দেখেছিল। তবে এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। সবাই বুঝতে পেরেছে যে, জুলিয়ান ভুক্তভোগী হয়েছেন।"
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় একটা অংশের কাছে অ্যাসাঞ্জের ভাবমূর্তি এখনও বিতর্কিত। যেমন, দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হাইকমিশনার আলেকজান্ডার ডাউনার মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার এই ঘটনায় সম্পৃক্ত হওয়া উচিত নয়।
এদিকে সিনেটর পিটার হুইশ-উইলসন বলেছেন, "যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে একটি ভয়ংকর ও বিব্রতকর সত্য বলার জন্য অ্যাসাঞ্জকে নির্যাতন করা হয়েছে।" অন্যদিকে বাকিরা অ্যাসাঞ্জ ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেননি।
এদিকে বার্নাবি জয়েস দীর্ঘকাল ধরে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির আহ্বান জানানো এমপিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতার চিকিৎসা ও মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে একইসাথে এও স্পষ্ট করেন যে, অ্যাসাঞ্জ যা করেছেন তা ঠিক বলে তিনি মনে করেন না।
এক্ষেত্রে অ্যাসাঞ্জের মুক্তির বিষয়ে অনেকেই সোচ্চার ছিল। কিন্তু তাকে হিরো কিংবা খ্যাতিমান সাংবাদিক হিসেবে তুলে ধরা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
তবে সব বিতর্ক ছাপিয়ে অ্যাসাঞ্জ অস্ট্রেলিয়ার ফিরে এসে নতুন জীবন শুরু করেছেন। আগামী সপ্তাহে তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর পর পরিবারের সাথে নিজের ৫৩তম জন্মদিন উদ্যাপন করবেন।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান