জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি, উইকিলিকসের ভূত-ভবিষ্যৎ ও বাংলাদেশ
উইকিলিকস ও গোপন নথি
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা। যাত্রীবাহী জেট বিমান ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেইড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে। এ ঘটনায় নিহত হন কয়েক হাজার মানুষ।
৯/১১ বা নাইন ইলেভেন নামে পরিচিত এ হামলার পরই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়াতে মার্কিন সৈন্য-সামন্ত তাদের ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেন।
আল-কায়েদা, তালেবান কিংবা আইএস দমন অথবা ইরাক, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা হয়; মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসির তথ্যমতে, নাইন ইলেভেনের পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুদ্ধে ৮ লাখ ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া সহিংসতার কারণে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে রক্তের হোলি খেলায় লাভবান হয়েছে শুধু অস্ত্র উৎপাদক, সরবরাহকারী ও ঠিকাদাররা। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ অর্থবছরে ফেডারেল সরকারের মোট ব্যয়ের চেয়ে এই পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি।
পিছিয়ে ছিলেন না বিনোদন কর্মীরাও! এ নিয়ে হলিউডে তৈরি হয়েছে টুয়েলভ স্ট্রং, দ্য আউটপোস্ট, জিরো ডার্ক থার্টির মতো বিভিন্ন অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমা। দেখানো হয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বীরত্বের গল্প-গাঁথা। দেখানো হয়েছে, কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সৈন্যরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
সিনেমা বা গণমাধ্যম ব্যবহার করে বহির্বিশ্বে সন্ত্রাস নির্মূলের ত্রাণকর্তা সাজলেও আড়ালে ঢেকে ছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ।
২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মার্কিন বাহিনীর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে— বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা ব্যতিরেকেই নির্বিচারে হামলার পরিকল্পনা— যাতে বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন, গোপন আটক, গোপন বন্দী স্থানান্তর, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণের শিকার হয়েছেন অনেকে।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বন্দিরা আটক কেন্দ্রগুলোতে তাদের ওপর চালানো বিভিন্ন নির্যাতনের কথাও জানিয়েছেন। যেমন— ঘুমাতে না দেওয়া, জোরপূর্বক নগ্ন করে রাখা, পর্যাপ্ত খাবার ও জল না দেওয়া, ভুয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এবং ধর্ষণের হুমকি।
২০১০ সালে যুদ্ধের একটি ভিডিও ও কিছু গোপন নথি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধের আড়ালের মুখোশ বেরিয়ে আসতে থাকে, বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
সেই বছরের ৫ এপ্রিল ২০০৭ সালে ধারণ করা ইরাক যুদ্ধের ৩৯ মিনিটের একটি ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়, কীভাবে একটি মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে ইরাকের বাগদাদে বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। এমনকি, সেই ভিডিওতে শোনা যায় কেউ একজন নির্দেশ দিচ্ছেন 'সবাইকে গুলি করো'।
আহতদের উদ্ধারে একটি ভ্যানও এগিয়ে এসেছিল। বাদ যায়নি সেটিও, লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় গুলি। ওই হামলায় রয়টার্সের আলোকচিত্রী নামির নুর এলদিন, তার সহযোগীসহ ১৮ জন বেসামরিক লোক নিহত হন।
আলোচিত এই ভিডিও এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর বর্বরতার গোপন তথ্য ফাঁস করে তোলপাড় সৃষ্টি করে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জের ওয়েবসাইট 'উইকিলিকস'। অনলাইনভিত্তিক এই অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপের মূল লক্ষ্য অজ্ঞাত সূত্র থেকে পাওয়া গোপন তথ্য ও দলিল জনসমক্ষে প্রকাশ করা।
২০১০ সালের জুলাইয়ে সাবেক মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের সহায়তায় উইকিলিকস এবং নিউইয়র্ক টাইমসসহ অন্যান্য গণমাধ্যম, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কিত ৯০ হাজারেরও বেশি মার্কিন সামরিক গোপন নথি প্রকাশ করে।
এই নথিগুলোতে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন, ন্যাটো বাহিনীর সামরিক কর্মকাণ্ড, বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, বন্ধুত্বপূর্ণ হামলায় হতাহতের ঘটনা, মার্কিন বিমান হামলা, দেশটিতে আল-কায়েদার ভূমিকা এবং আফগান নেতা ও তালেবানকে সহায়তা প্রদানকারী দেশগুলো সম্পর্কে পূর্বে অপ্রকাশিত বিবরণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ম্যানিংয়ের ফাঁস করা ফুটেজটি বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল এবং ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উপস্থিতি নিয়ে চলা বিতর্ককে আবার পুনরুজ্জীবিত করেছিল।
এসব নথিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী কয়েকশো বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, যা নথিভুক্ত হয়নি। আর ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস করার পর তাতে দেখা গেছে, ৬৬ হাজারের বেশি বেসামরিক লোক হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাগুলো সবসময় জনসাধারণের দৃষ্টির অগোচরেই রাখা হয়েছে।
এছাড়া, সেনাদের দ্বারা বন্দিদের নির্যাতনের তথ্য এবং মার্কিন কূটনীতিকদের আদান প্রদান করা আড়াই লাখ বার্তাও ফাঁস করেছিল উইকিলিকস।
একনজরে উইকিলিকসে ফাঁস করা তথ্যসমূহ:
উইকিলিকস প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাধিক বড় এবং আলোচিত তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:
কোল্যাটারাল মার্ডার ভিডিও (২০১০):
এপ্রিল ২০১০-এ প্রকাশিত এই ভিডিওতে ২০০৭ সালে বাগদাদে মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে বেসামরিক নাগরিক এবং সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালানোর ফুটেজ ছিল। ভিডিওটি বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
আফগান যুদ্ধ নথি (২০১০):
জুলাই ২০১০-এ উইকিলিকস ৯০ হাজারেরও বেশি নথি প্রকাশ করে, যেখানে ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে মার্কিন সামরিক ক্রিয়াকলাপের বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়। এতে বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা এবং আল-কায়েদার ভূমিকা সম্পর্কিত তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইরাক যুদ্ধ নথি (২০১০):
অক্টোবর ২০১০-এ উইকিলিকস প্রায় চার লাখ মার্কিন সামরিক নথি প্রকাশ করে, যা ইরাক যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু, অত্যাচার এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ দেয়।
নাইন ইলেভেন পেজার বার্তা (২০১০):
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার দিন মানুষজন একে অন্যের খবর নিতে যে পেজার বার্তা প্রদান করেছিল, তারমধ্যে থেকে প্রায় ছয় লাখ বার্তা উইকিলিকস প্রকাশ করেছিল। এই বার্তাগুলোর মধ্যে হামলার শিকার ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে স্বজনদের আদান-প্রদান করা বার্তাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া, ওই সময়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রতিক্রিয়া এতে ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বার্তাটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কিত— যেখানে লেখা ছিল, 'প্রেসিডেন্টের গমনপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি ওয়াশিংটনে ফিরছেন না। তবে কোথায় যাবেন, তা নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।'
গুয়ানতানামো ফাইলস (২০১১):
এপ্রিলে উইকিলিকস গুয়ানতানামো বে আটক শিবিরে বন্দিদের ওপর মার্কিন সামরিক মূল্যায়ন ফাইলগুলো প্রকাশ করে, যা বন্দিদের অধিকার এবং বিচারবহির্ভূত আটক সম্পর্কিত বিবরণ দেয়।
সিরিয়া ফাইলস (২০১২):
জুলাইয়ে উইকিলিকস সিরিয়া সরকার এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২.৪ মিলিয়ন ই-মেইল প্রকাশ করে, যা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করে।
ডিএনসি ই-মেইল ফাঁস (২০১৬):
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণা প্রধান জন পোডেস্টার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয় এবং কয়েক হাজার ইমেইল ফাঁস করা হয়। এসব ই-মেইলে ডেমোক্র্যাট পার্টির মনোনয়নের আগে দলের মধ্যে হিলারি ক্লিনটনের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছিল— যা প্রাথমিক প্রচারণা চলাকালীন বার্নি স্যান্ডার্সের বিরুদ্ধে ডিএনসির পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয়। এই ফাঁসটি ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল।
সিআইএ-এর ভল্ট ৭ (২০১৭):
মার্চ ২০১৭-এ উইকিলিকস 'ভল্ট ৭' নামে পরিচিত সিআইএ-এর গোপন নথি প্রকাশ করে— যেখানে সিআইএ-এর সাইবার গোয়েন্দাগিরির ক্ষমতা এবং সরঞ্জামগুলো সম্পর্কে বিশদ বিবরণ ছিল। এরমধ্যে হ্যাকিংয়ের কৌশল এবং বিভিন্ন ডিভাইস কম্প্রোমাইজ করার পদ্ধতিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
উইকিলিকসের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে মার্কিন প্রশাসন। নথি ফাঁসের ঘটনায় অ্যাসেঞ্জের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা দায়ের করে মার্কিন বিচার বিভাগ। উইকিলিকস বন্ধে নানান চেষ্টা চালায় ওয়াশিংটন। বেশ কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে আসছিল, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের যেসব গোপন তথ্য উইকিলিকস প্রকাশ করেছে— তা মানুষের জীবন বিপন্ন করার জন্য দায়ী।
সুইডেনে যৌন হয়রানির মামলায় লন্ডনে গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে পালিয়ে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। সেখানে বসেই কাজ চালিয়ে যান। তারপর পাঁচ বছর ব্রিটিশ কারাগারে কাটিয়েছেন অ্যাসাঞ্জ। এই পুরোটা সময়জুড়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।
কয়েক বছরের আইনি লড়াইয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের দোষ স্বীকার করবেন— এমন চুক্তিতে পৌঁছানোর পর সোমবার (২৩ জুন) তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার রক্ষায় অসামান্য অবদান রাখায় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে উইকিলিকস এবং অ্যাসাঞ্জ। অনেকে উইকিলিকসকে বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম হিসেবে অভিহিত করেন।
পেন্টাগন পেপার্স থেকে উইকিলিকস
অনুসন্ধানভিত্তিক সাংবাদিকতায় হুইসেল ব্লোয়াররা সবসময়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন বা পানামা পেপার্স অনুসন্ধানের পেছনে থাকা 'জন ডো' (যার আসল পরিচয় এখনো অজানা) কিংবা প্রাক্তন বোয়িং কোয়ালিটি ম্যানেজার জন বার্নেটের মতো হুইসেলব্লোয়াররা জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করে অপরিসীম সততা এবং সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। দেখিয়েছেন, তথ্য-ফাঁসের সাংবাদিকতা দিয়ে কত বড় পরিবর্তন আনা যায় সমাজে।
হুইসেল ব্লোয়ার ও অগণিত গোপন সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই ২০০৬ সালে চালু হয় ডিজিটাল হুইসেল ব্লোয়িং প্লাটফর্ম উইকিলিকস। এর প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার প্রোগ্রামার জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ। উইকিলিকসের ওয়েবসাইটটি নিবন্ধিত হয় ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর। সংস্থাটির নিজস্ব কোনো সদরদপ্তর নেই। নেই কোনো বেতনভুক্ত কর্মী, চলে অনুদান ও স্বেচ্ছাসেবীদের শ্রমে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের চাঞ্চল্যকর নথি 'পেন্টাগন পেপারস' ফাঁসকারী ড্যানিয়েল এলসবার্গ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যাসাঞ্জ।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হোয়াইট হাউসে পরমাণু অস্ত্র কৌশল সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পরামর্শদাতা ছিলেন এলসবার্গ। ১৯৬০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাকে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভিয়েতনামে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণে পাঠানো হয়।
যুদ্ধকালীন ভিয়েতনামে অবস্থানকালে এলসবার্গ একেবারে কাছ থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এতে তার মনে হয়েছিল, মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষে ভিয়েতনাম যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়।
এলসবার্গ ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত গোপন তথ্য জানার পর বুঝতে পারেন, মার্কিন সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। দেশে ফিরে তিনি প্রকৃত তথ্য দেশবাসীকে জানিয়ে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।
এই ভাবনা থেকেই এলসবার্গ আমেরিকার সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকদের কাছে মার্কিন সরকারের বহু গোপন নথি তুলে দেন। যার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় ৭ হাজার পৃষ্ঠার বিস্ফোরক 'পেন্টাগন পেপারস'।
সংবেদনশীল তথ্যগুলো প্রকাশের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। নিক্সন প্রশাসন সংবাদপত্রে ফাঁস হওয়া তথ্য নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ রোধ করতে এবং এলসবার্গকে শায়েস্তা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
শেষ পর্যন্ত মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। তবে এলসবার্গের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়। এছাড়াও, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে সংবাদপত্রের পক্ষেই রায় দেন।
উইকিলিকসের প্রথম ডকুমেন্ট ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, সোমালিয়ার এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা সেদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের গুপ্তহত্যা করতে ভাড়া করা সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছেন।
উইকিলিকস যেভাবে কাজ করে
সূত্রের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করে উইকিলিকস। লাখ লাখ তথ্য ও দলিল সংরক্ষণে সুরক্ষিত সার্ভার ব্যবহার করে তারা। সূত্র ও হুইসেল ব্লোয়ারদের পরিচয় যাতে প্রকাশ না পায়, এজন্য বিশেষ ক্রিপ্টোগ্রাফিক অ্যানক্রিপশন টুল ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি। হুইসেল ব্লোয়াররা তাদের পরিচয় প্রকাশ ব্যতীত সাবমিশন প্লাটফর্মে গোপন নথি জমা দিতে পারেন।
এই অ্যানক্রিপটেড সাবমিশন প্লাটফর্ম সূত্রের সুরক্ষা ও নামহীনতা নিশ্চিত করে, যা ভয় ছাড়াই সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে মানুষকে উৎসাহ দেয়।
হুইসেল ব্লোয়ারদের পরিচয় কঠোরভাবে রক্ষা করা হয় বলেই, উইকিলিকস সহজে এমন গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
তথ্য জমা হওয়ার পর, উইকিলিকস তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কঠোর যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং মিথ্যা তথ্য প্রচার এড়াতে যাচাইকরণ প্রক্রিয়া অপরিহার্য। এজন্য, অন্যান্য সূত্রের সাথে তথ্যসমূহের ক্রস-চেক করা এবং প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়।
নথিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করার মাধ্যমে, উইকিলিকস নিশ্চিত করে যে তারা যে তথ্য প্রকাশ করে, তা সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তিকে অনেকে সাংবাদিকতার বিজয় হিসেবে দেখছেন। কিন্তু আদতে বিষয়টি কি তেমন?
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক গোপন তথ্য ফাঁসের যে ফৌজদারি অভিযোগ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, আদালতে তিনি তা স্বীকার করবেন— এই শর্তেই তাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আর তার দোষ স্বীকার করার অর্থ হলো এই যে, ২০১০-১১ সালে উইকিলিকস কর্তৃক মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর যে কাণ্ডগুলো সবার সামনে এসেছে, তা জানবার অধিকার সকলের নেই— এ বিষয়টিকে একরকম বৈধতা দেওয়া হলো। এটি কি সাংবাদিকতার মূলনীতির ওপর সরাসরি কুঠারাঘাত নয়?
বাইডেন প্রশাসন যে মুহূর্তে ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তারা চাইলে অ্যাসাঞ্জের ওপর থেকে এই অভিযোগ তুলে নিতে পারতো। কিন্তু তারা এটিকে জিইয়ে রেখেছে। যখন অ্যাসাঞ্জকে মুক্তি দেওয়া হলো, তখনও তাকে দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কোনো সাংবাদিক এমনটি করবার কথা না ভাবেন। উল্লেখ্য যে, অ্যাসাঞ্জকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি।
ইরাক ও আফগান যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মতো বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে আনা এই ঘটনার ফলে আরও কঠিন হয়ে গেল। অথচ শুধু মার্কিন কেন, সারাবিশ্বের নাগরিকদের এই বিষয়গুলো জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু গোপন নথি ও গুপ্তচরবৃত্তির শাক দিয়ে অধিকারের মাছ ঢেকে ফেলা হয়েছে।
উইকিলিকসের মতো প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে (বা অকল্যাণে) বর্তমানে সরকারি বহু নথি জনগণের সামনে আসছে। বিশ্ব মোড়লদের নানা কাণ্ডকীর্তির কথা এতে প্রকাশ পাচ্ছে। সারা বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নীতি যে মোড়লেরা ঠিক করে দেয়, তাদের স্বরূপ এর মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এর ফলে মানুষের ক্ষমতায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদান- 'তথ্যপ্রাপ্তি', সেটির সুযোগ অনেকাংশে নিশ্চিত হয়।
তবে এই তথ্যপ্রাপ্তির ধরন নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে। গুপ্তচরবৃত্তি আর সাংবাদিকতাকে এক পাল্লায় মাপতে রাজি নন উইকিলিকস-বিরোধীরা। তাদের মতে, সকল রাষ্ট্রীয় নথি সর্বসম্মুখে আনবার মতো নয়, তাছাড়া এর দরকারও নেই। সরকার কী গোপন করবে আর করবে না, এই দোলাচলে অনেক সময় সাধারণ নাগরিকদের সরকারের প্রতি অবিশ্বাস জন্ম নেয়, বাজারে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে গুজব। যেমনটি আমরা কোভিডের সময় দেখেছি।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তিতে উইকিলিকসের কার্যক্রম যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গলার কাঁটা হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ স্বীকারের ঘটনা প্রতিষ্ঠানটিকে ভোগাতে পারে। বিশেষত, মার্কিন গোপন নথি প্রকাশে উইকিলিকসের তৎপরতা এখন কেমন হয়, সেটিই দেখবার পালা।
উইকিলিকস ও বাংলাদেশ
উইকিলিকসের গোপন নথি ফাঁসের তালিকায় বাংলাদেশের নামও এসেছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বিভিন্ন সময় পাঠানো তারবার্তা প্রতিষ্ঠানটি ফাঁস করে। এরমধ্যে ৭৩টি তারবার্তা নিয়ে মশিউল আলমের অনুবাদ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ' বইটি।
এই বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোর এক প্রবন্ধে বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। উইকিলিকসের সাহায্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং আত্মরক্ষার জন্য ভীষণভাবে মার্কিন মুখাপেক্ষী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল করে তোলা এবং সেই জটিলতার সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মার্কিনীদের হীন চাল উইকিলিকস ফাঁস করে দেয়।
'উইকিলিকসে বাংলাদেশ' বই অনুসারে, ২০০৭ সালের ৪ জুন দুপুরে পাঠানো এক তারবার্তায় (তারবার্তা নং ০৭ ঢাকা ৯০৭) লেখা হয়, "সামরিক বাহিনী একটি নতুন 'কিংস' পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে বিএনপির রাজনীতিকদের টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু 'দুই ভদ্রমহিলা'কে সরিয়ে দেওয়ায় ব্যর্থতা, নতুন দলটির জন্য গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং জেনারেল মইনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে মিশ্র সংকেতের কারণে নতুন দলটির সম্ভাব্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক বাহিনীর প্রস্থানকৌশল যদি হয় দুই প্রধান দলকে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি 'কিংস' পার্টি গঠন করা এবং পরবর্তী সরকারের আমলে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে আমাদের অনুমান হচ্ছে, নতুন দলটিকে [আগামী নির্বাচনে] বিজয়ী হতে হলে সময় এবং সামরিক বাহিনীর জোরালো সমর্থনের প্রয়োজন হবে।" (পৃষ্ঠা: ২০৯)
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বেশ জলঘোলা হয়েছে। বহু সামরিক কর্তা পড়েছে নিষেধাজ্ঞার কবলে। আদতে পর্দার আড়ালে কী ঘটেছে সেটি প্রকাশে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে কি–না, সময়ই তা বলে দেবে।