প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট: ট্রাম্পের সত্যমিথ্যা মেশানো তোপের মুখে নড়বড়ে বাইডেন
শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার (২৮ জুন) সকাল সাতটার দিকে জর্জিয়ার সিএনএনের আটলান্টা স্টুডিওতে এই বিতর্ক শুরু হয়। ২০২০ সালে ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন ট্রাম্প ও বাইডেন।
৯০ মিনিটের এ বিতর্কে ডেমোক্র্যাট বাইডেন ও রিপাবলিকান ট্রাম্প অর্থনীতি, সীমান্ত ইস্যু, ইউক্রেন ও ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ, শিশু ও স্বাস্থ্যসেবা, কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা এবং গর্ভপাতসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন এবং একে অন্যকে লক্ষ্য করে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ করেছেন। বিতর্কে ট্রাম্প ৪০ মিনিট ১২ সেকেন্ডের মতো কথা বলেছেন। অপর দিকে বাইডেন কথা বলেছেন ৩৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ড।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতি সামলানো, পররাষ্ট্র নীতির রেকর্ড ও ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর বিষয়ে বাইডেনের তীব্র সমালোচনা করেন। অন্যদিকে আদালতে সম্প্রতি ট্রাম্পের ফৌজদারি সাজার প্রসঙ্গ তুলে ট্রাম্পকে 'গণতন্ত্রের জন্য হুমকি' বলে উল্লেখ করেন।
তবে বিতর্কে শেষে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা হতাশই হয়েছেন বলা চলে। ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ট্রাম্পকে জোরালোভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি বাইডেন।
বিতর্কের আগে অনেক মার্কিনি জো বাইডেনের বয়স ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিতর্ক শেষে সে দুশিন্তা আগের মতোই রয়ে গেছে। কথা বলার সময় বাইডেনকে অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল, তিনি অস্পষ্টভাবে কথা বলছিলেন এবং মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছিলেন।
বিতর্কের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে বাইডেনের প্রচারণা শিবির এসে সাংবাদিকদের জানান, প্রেসিডেন্টের গলায় ঠাণ্ডা লাগার জন্য কণ্ঠস্বরে সমস্যা হচ্ছে, তবে অনেকেই এটিকে অজুহাত হিসেবে দেখছেন।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক করউইন স্মিডের মতে, বাইডেন বিতর্কে নিজেকে উপস্থাপন করতে হিমশিম খেয়েছেন। তার বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর এবং তিনি যেভাবে যুক্তি সরবরাহ করেছেন তা বিভ্রান্তিকর। বাইডেন তথ্যভিত্তিক কথা বলতে চাইলেও তা প্রায়শই তার কথার মাঝে হারিয়ে গেছে । তবে ট্রাম্পের চরিত্র নিয়ে বাইডেনের কিছু সমালোচনা অবশ্য মানুষের মনে সাড়া ফেলেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ উপদেষ্টা ও বর্তমানে সিএনএনের রাজনৈতিক আলোচক ভ্যান জোনস বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিতর্ক অনুষ্ঠানটি ছিল 'বেদনাদায়ক'।
সিএনএনের সঞ্চালক অ্যাবি ফিলিপ বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যা দাবিগুলোর যুক্তিখণ্ডন কার্যকরভাবে করতে পারেননি।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও স্বীকার করেছেন যে বাইডেন ধীরগতিতে শুরু করেছিলেন। তবে তার দাবি, 'বাইডেন পরে দৃঢ়ভাবেই বিতর্ক শেষ করতে পেরেছেন।'
সিএনএন সঞ্চালকদের দ্বারা উত্থাপিত প্রথম কয়েকটি বিষয় যেমন— অর্থনীতি এবং অভিবাসনের মতো ইস্যুগুলোতে আমেরিকানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর বেশি আস্থা রাখছেন—এমনটাই দেখা গেছে জরিপে।
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কে ভালো অবস্থানে ছিলেন। ২০২০ সালের বিতর্কের মতো তিনি কোনো বাধা দেননি বা আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলেননি। বরং বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনায় মনোনিবেশ করেছেন তিনি। ট্রাম্প এমন অনেক দাবি করেছেন যা সত্য নয়, তবে বাইডেন জোরালো ভাবে এসব বিষয়ের পালটা যুক্তি দিতে পারেননি।
বিতর্কের বিষয়টি যখন গর্ভপাতের দিকে মোড় নেয়, তখন ট্রাম্প বারবার মিথ্যা দাবি করেন যে ডেমোক্র্যাটরা শিশু জন্মের পরে গর্ভপাতকে সমর্থন করে, যা আদতে সত্য নয়।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, বিভিন্ন রাজ্যে গর্ভপাতের উপর বিধিনিষেধের জন্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই দায়ী।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্টে তিনজন বিচারক নিয়োগ করেন, যাদের সাহায্যে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করা হয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প এটার জন্য কৃতিত্ব দাবী করেন।
এই বিষয়টিকে বাইডেন বিতর্কে তার পক্ষে ব্যবহার করতে পারলেও, সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। তার যুক্তি ও সমালোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
'আপনি যা করেছেন তা একটি ভয়ানক জিনিস', এতটুকুই বলেন বাইডেন।
বিতর্কের পারফরম্যান্স নিয়ে তার কোনো উদ্বেগ আছে কিনা জানতে চাইলে বাইডেন বলেন, তিনি ভালোই করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করে বলেন, 'মিথ্যাবাদী নিয়ে বিতর্ক করা কঠিন।'
গত ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হামলার সময় নিজের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ট্রাম্পকে। বরং বাইডেনের রেকর্ডকে আক্রমণ করে নিজের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন এড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে বাইডেন তাকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে দেননি। বাইডেন বলেন, 'তিনি ক্যাপিটল হিলে যেতে লোকদের উৎসাহিত করেছেন। তিনি সেখানে তিন ঘন্টা বসে ছিলেন কারণ তার সহযোগীরা তাকে কিছু করার জন্য অনুরোধ করেছিল।'
বিতর্কের সময় ট্রাম্প অন্যান্য কঠিন প্রশ্নও এড়িয়ে যান।
ট্রাম্প নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বাইডেন। তিনি বলেন, 'ট্রাম্প রাতে এক পর্ন তারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন অথচ তখন তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।'
জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'আমি কোনো পর্নো তারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করিনি।'
বাইডেন শিবিরের অনুরোধে এবার নির্বাচনের অনেক আগেই প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হলো। সেপ্টেম্বরে আরও একটি বিতর্ক হওয়ার কথা রয়েছে, যা নভেম্বরের নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে।
তবে ডেমোক্র্যাটদের একাংশের আশঙ্কা, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরেকটি বিতর্কও হয়ত ভিন্ন কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না। এমনকি বিকল্প প্রার্থী নিয়েও জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে, যদিও বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ডেলিগেট পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট প্রকাশ্যে বাইডেনের বিরোধিতা করেননি, তবে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সম্ভাব্য প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসা করা হলে, ডেপুটি ক্যাম্পেইন ম্যানেজার কুয়েন্টিন ফুলকস উত্তর দিতে অস্বীকার করেন, মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বাইডেনের অবস্থান নিশ্চিত করেন এবং তার বিজয়ের পূর্বাভাস দেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প এর আগেও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে রাজনীতিতে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। তবে আজ রাতের বিতর্কের পর নভেম্বরে বাইডেনের বিজয় নিয়ে অনেক ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হতেই পারে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন