যুক্তরাজ্যের নির্বাচন: ১৯৯৭'র নির্বাচনের ভূমিধস জয়ের চেয়েও বড় জয় পাবে লেবার পার্টি— জরিপ
যুক্তরাজ্যে আজ (৪ জুলাই) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচনে কেয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি রেকর্ড ভূমিধস জয় পাবে বলে এক জরিপে আভাস পাওয়া গেছে।
১৮ বছরের কনজারভেটিভ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ার ভূমিধস জয়ের রেকর্ড করেন। আর মধ্য-বাম দলটির এবার ১৯৯৭ সালের চেয়েও বেশি আসন পাওয়ার ব্যাপারটি ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত বলে জরিপে উঠে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট এবং গভীরভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জর্জরিত একটি দেশের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।
গত ১৪ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় আছেন ডানপন্থী কনজারভেটিভরা। তবে এবার তারা মূলত নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন কট্টর-ডানপন্থী দলটিকে মোকাবিলার চেষ্টা করছে।
টেলিজেনিক পপুলিস্ট ও ব্রেক্সিটের মূল স্থপতি ফারাজ এবার আশা করছে রিফর্ম ইউকে পার্টি এবার জনপ্রিয়তা অর্জন করবে।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার রাজনীতি ও জননীতি বিভাগের অধ্যাপক টবি জেমস বলেন, 'নতুন সরকারকে অনেকগুলো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'লেবার পার্টি যদি ভবিষ্যদ্বাণীর মতো সত্যিই ভূমিধস জয় পায়, এই জয় তাহলে ১৯৯৭ সালে (টনি) ব্লেয়ারের জয়ের মতোই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।'
জেমস আল জাজিরাকে বলেন, 'তবে বর্তমান পরিস্থিতি ব্লেয়ারের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ... ১৯৯৭ সালে অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠেছিল, আর সম্প্রতি প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর। রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যও বেশি। বড় ধরনের সরকারি ঋণও রয়েছে।'
তবে গত ছয় সপ্তাহের প্রচারণায় বোঝা যায়, লেবার পার্টি কোনো কিছুই হালকাভাবে নিচ্ছে না এবং তারা ব্রিটেনবাসীকে বারবার ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
২০১৯ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৭.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৮.৮ শতাংশ।
১৯৯৭ সালে ভোটদানের হার ছিল ৭১.৪ শতাংশ এবং ১৯৯২ সালে এ হার ছিল ৭৭.৭। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ নেতা জন মেজর জিতেছিলেন।
সারভেশন বলেন, লেবার পার্টি ৪২ শতাংশ ভোট পেতে পারে, অর্থাৎ, মোট ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৪৮৪টি আসন পেতে পারে।
সাবেক কনজারভেটিভ কেন্দ্রগুলোতে বিপর্যয়কর পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, কনজারভেটিভরা যে এবার ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে 'অতীতের যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে কম ভোট পাবে তা মোটামুটি নিশ্চিত'।
২০২২ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব নেওয়া কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক গত মে মাসে নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন।
জেমস বলেন, লেবার পার্টি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে এবং কনজারভেটিভরা প্রধান বিরোধী দল হতে পারে।
ফ্রান্সের সাম্প্রতিক নির্বাচনে মারিন লে পেনের অতি-ডানপন্থী দলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাইজেল ফারাজ কনজারভেটিভ পার্টির জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। এবার সবার নজর থাকবে রিফর্ম পার্টি কতটি আসনে জিতবে তার উপর।
তিনি সুনাকের মেয়াদকে 'সংক্ষিপ্ত এবং অত্যন্ত কঠিন' বলে অভিহিত করেছেন।
জেমস বলেন, 'মহামারি পরবর্তী ধাক্কা, মূল্যস্ফীতির ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং কনজারভেটিভ পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। খুব কম প্রধানমন্ত্রীই এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।'
'রাজনীতিবিদরা প্রায়ই ভোটের জন্য অভিবাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন'
এদিকে অর্থনীতির পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচারণার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি হাতিয়ার হলো অভিবাসন।
এর আগে কনজারভেটিভ দলের যেসব নেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় (ব্রেক্সিট) অভিবাসী কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন।
২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে নিট অভিবাসন আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কমে ৬ লাখ ৮৫ হাজারে নেমে আসে। তবে গড় হিসাবে সংখ্যাটি বেশিই বলা যায়।
গত বছর যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোদের বেশিরভাগই গেছেন কাজ বা পড়াশোনার জন্য। তবে নথি অনুযায়ী গত বছর ফ্রান্স থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ২৯ হাজার ৪৩৭ অভিবাসী ও শরণার্থী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছেন।
উল্লেখ্য, সাবেক কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী যেমন ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মে নিট অভিবাসন ১০ হাজারে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইউকে অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার এমিলি ম্যাকডোনেল বলেন, 'রাজনীতিবিদরা প্রায়ই নির্বাচনে বেশি ভোট পাওয়ার আশায় প্রচারণার সময় অভিবাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রায়ই আমরা অভিবাসীদের ওপর কে সবচেয়ে কঠিন নীতি আরোপ করতে পারে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখতে পাই।'
এদিকে লেবার পার্টি আবার কনজারভেটিভদের শুরু করা বিতর্কিত রুয়ান্ডা স্কিম বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ স্কিমের লক্ষ্য হলো রুয়ান্ডায় আশ্রয়ের দাবি প্রক্রিয়ার জন্য অনথিভুক্ত শরণার্থী ও অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো।
তবে আইনগত বিরোধিতা ও মানবিক উদ্বেগের কারণে এখন পর্যন্ত কাউকে এভাবে ফেরত পাঠানো হয়নি।
ম্যাকডোনেল বলেন, 'রুয়ান্ডা স্কিম বাতিল করা এবং যারা অবৈধভাবে আসছেন তাদের আশ্রয় প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা যুক্তরাজ্যে শরণার্থী সুরক্ষা পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য বিষয়। তবে একটি ন্যায্য এবং সহানুভূতিশীল আশ্রয় ব্যবস্থা তৈরির জন্য অনেক কিছুই করার আছে। যাতে এটা দেখানো যায় যে বিশ্বের শরণার্থীদের সুরক্ষায় যুক্তরাজ্য তার জায়গা থেকে যথাসম্ভব ভূমিকা রাখবে।'
পর্যবেক্ষকরা যেসব ব্রিটিশ শহরে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব শহরের ওপর গভীরভাবে নজর রেখেছেন। গাজা যুদ্ধের বিষয়ে নিজেদের অবস্থানের কারণে লেবার পার্টি এসব শহরে কিছুটা সমর্থন পাবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
সুনাকের মতোই স্টারমারও ইসরায়েলকে সমর্থন করে আসছেন। এমনকি প্রায় ৩৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পরও তারা (ইসরায়েলের) 'প্রতিরক্ষার অধিকার' নিয়ে কথা বলছেন।
এদিকে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা আগামী শনিবার লন্ডনে বড় ধরনের বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছেন।
প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইন (পিএসসি) ও এর অংশীদাররা জানিয়েছেন, আগের মতোই তাদের কর্মসূচির অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
পিএসসি নেতা বেন জামাল বলেন, 'শান্তিপূর্ণ যে কোনো প্রতিবাদের অধিকারকে, যেমন: ওয়েস্টমিনিস্টারের পাশে হওয়া প্রতিবাদ আন্দোলনকে সমর্থন করা নিয়ে কেয়ার স্টারমার প্রথম পরীক্ষায় পড়েছেন। ইতোমধ্যে পার্লামেন্টের আশেপাশে হওয়া বিক্ষোভ থামাতে টোরি সরকারের পাস করা আইন অনুযায়ী দমনমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে মেট পুলিশ। প্রশ্ন হলো [নতুন সরকার] কি প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে?'
এছাড়া, গাজা যুদ্ধ নিয়ে স্টারমারের অবস্থানের কারণে গত অক্টোবরে ছয় বছর ধরে অক্সফোর্ডে লেবার কাউন্সিলর পদে থাকা শায়েস্তা আজিজ পদত্যাগ করেন।
শায়েস্তা আজিজ জানান, সাধারণ নির্বাচন থেকে নিজেকে 'বিচ্ছিন্ন' মনে করছেন তিনি।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'ভোট দিতে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করছি না। যদিও আমরা সবাই দেশে ১৪ বছরের ধ্বংসযজ্ঞের পরে, এই বিপর্যয়কর টোরি সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে চাই।'
তিনি বলেন, 'লেবার পার্টিকে গাজায় দৃঢ় নীতিগত নেতৃত্ব দেখাতে হবে; যা আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনকে সমুন্নত রাখে এবং যা দখলকৃত ও দখলদারের মধ্যে মিথ্যা সমতা তৈরি করে না। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, তারা এসবের কোনোটিই করতে পারেনি।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি ও রেদওয়ানুল হক বিজয়