টিউলিপ সিদ্দিক কেন পদত্যাগ করলেন? কীভাবে সম্পত্তি বিতর্কে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট বা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের থেকে পাওয়া তার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে।
বাংলাদেশেও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন টিউলিপ। ফিনান্সিয়াল টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দ্য টাইমস, দ্য মেইলসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক প্রতিবেদন।
সরকারের দুর্নীতি বিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক জানতেন, মন্ত্রী হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হলে তার নির্দোষ প্রমাণিত হওয়াই একমাত্র পথ।
তবে গতকাল লরি ম্যাগনাস জানান, সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধ মন্ত্রী মন্ত্রীসভার নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন এমন কোনো প্রমাণ তিনি পাননি, তবে তাকে পুরোপুরি নির্দোষ ঘোষণা করাও সম্ভব নয়।
এই প্রতিবেদনের ছয় মাস আগেও ভোটারদের কাছে 'নৈতিক সরকার'-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া স্যার কিয়ার স্টারমারকে শেষমেশ কঠিন পথেই হাটতে বাধ্য হতে হয়—নিজের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও ব্যক্তিগত বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না তার কাছে।
পারিবারিক সম্পর্ক ও বিতর্ক
টিউলিপ সিদ্দিক একজন ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ। তার খালা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন ভারতে অবস্থান করছেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পসহ নানা খাত থেকে বরাদ্দ করা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ডিসেম্বরে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে, যেখানে টিউলিপ সিদ্দিকের নামও উঠে আসে। ম্যাগনাস তার প্রতিবেদনে বলেন, টিউলিপ 'তার পরিবারের বাংলাদেশের সাথে সংযোগের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য সুনামের ঝুঁকি' সম্পর্কে আরও সতর্ক হতে পারতেন।
একারণে টিউলিপকে তার বর্তমান দায়িত্বে রাখার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে বিবেচনা করার পরামর্শ দেন ম্যাগনাস।
সম্পত্তি বিতর্ক
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্পত্তি নিয়ে ওঠা বিতর্ক তার মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটিয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রে ছিল কিংস ক্রস, হামস্টেড এবং ফিঞ্চলেতে অবস্থিত বিভিন্ন সম্পত্তি, যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে টিউলিপ এবং তার পরিবারের হাতে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট বিনামূল্যে পেয়েছিলেন টিউলিপ; হামস্টেডে আরেকটি ফ্ল্যাট তার বোনকে উপহার দেওয়া হয়েছিল; এছাড়া ফিঞ্চলেতে তিনি যেই বাড়িতে থাকেন সেটি একটি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন, যিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট।
ফিনানশিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালে আবদুল মোতালিফ নামে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকা একজন ডেভেলপার কিংস ক্রসের একটি ফ্ল্যাট ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে কিনেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে কোনো অর্থ ছাড়াই ফ্ল্যাটটি টিউলিপের নামে হস্তান্তর করা হয়। দ্য সানডে টাইমস জানায়, লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এলাকায় টিউলিপ সিদ্দিকের বোনকে বিনামূল্যে আরেকটি ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন মঈন গনি নামের একজন আইনজীবী, যিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ওই ফ্ল্যাটে একসময় টিউলিপও বসবাস করেছেন।
এছাড়া ইস্ট ফিঞ্চলেতে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার এক নির্বাহী সদস্যের মালিকানাধীন ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়ি ভাড়ায় নিয়েছেন টিউলিপ।
রাশিয়া ভ্রমণ
২০১৩ সালে মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের ছবিতে টিউলিপ সিদ্দিককে দেখা যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে টিউলিপ কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন কি না, তা নিয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, এ প্রকল্প থেকে তার পরিবারের সদস্যরা অর্থ আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছেন। যদিও ওই সময় তিনি ব্রিটেনের কোনো সরকারি দায়িত্বে ছিলেন না।
তবে টিউলিপ দাবি করেছেন, এই সফর শুধুমাত্র পরিবারের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করার জন্য ছিল এবং তিনি কোনো সরকারি আলোচনা বা চুক্তিতে অংশ নেননি। ম্যাগনাস তার বক্তব্যকে 'তথ্য প্রমাণের অনুপস্থিতিতে' মেনে নিলেও বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এখনও বিষয়টি তদন্ত করছে।
আরও তদন্ত
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখ হাসিনা এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে যে, তারা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে সম্পদ ক্রয়ে ব্যবহার করেছেন।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিভাগও (ইন্টারন্যাশনাল করাপশন ইউনিট) বর্তমানে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে কেনা সম্পত্তিগুলো চিহ্নিত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছে।
স্যার কিয়ার স্টারমার এবং সরকারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব তদন্ত সম্পন্ন হতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে এবং এর মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হতে পারে।
ম্যাগনাসের সিদ্ধান্ত
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে স্যার কিয়ার স্টারমারের মন্ত্রীসভার আচরণবিধি অনুযায়ী মূল্যায়ন করেন স্যার লরি ম্যাগনাস। নীতিমালা অনুযায়ী, মন্ত্রীরা নিশ্চিত করবেন যে তাদের সরকারি দায়িত্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি হবে না বা এমন কোনো ধারণা তৈরি হবে না।
ম্যাগনাস কোনো নীতিমালা ভঙ্গের প্রমাণ পাননি, তবে তদন্ত স্বভাবতই সীমিত ছিল। মাত্র আট দিনের মধ্যে তিনি সিদ্দিকের সম্পত্তি সংক্রান্ত কর এবং অর্থায়নের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত নথি সংগ্রহ করতে পারেননি। তিনি বলেন, এই তথ্যের অভাব 'দুঃখজনক'।
মস্কো ভ্রমণ এবং ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে সিদ্দিকের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়, কারণ এর বিপরীতে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের তদন্ত থেকে ভবিষ্যতে নতুন প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দেননি।
মূল বিষয়টি ছিল সিদ্দিক নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন কি না, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই প্রশ্ন—তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো সংঘাতের ধারণা তৈরি হতে পারে কি না। এ বিষয়ে ম্যাগনাস স্পষ্ট ছিলেন। ট্রেজারির দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে সিদ্দিকের দায়িত্ব ছিল যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক কাঠামোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক তার পরিবারের বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে সম্ভাব্য সুনামের ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না, যা 'দুঃখজনক'।
ম্যাগনাসের শেষ মন্তব্য স্টারমারের সামনে কোনো বিকল্প রাখেনি।
"আমি এই ত্রুটিকে মন্ত্রীসভার নীতিমালা ভঙ্গ হিসেবে বিবেচনার পরামর্শ দিচ্ছি না, তবে আপনি এই পরিস্থিতিতে তার দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চাইতে পারেন," ম্যাগনাস উল্লেখ করেন।
লেবার পার্টির মনোনয়নে গত বছর টানা চতুর্থবারের মতো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন টিউলিপ সিদ্দিক। এরপর গত জুলাইয়ে তাকে ইকোনোমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার পদে নিয়োগ দেয় প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার নেতৃত্বাধীন সরকার।
গত বছর ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসন থেকে টানা চতুর্থবারের মতো পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি ২০১৫ সালে প্রথম যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।